যুক্তফ্রন্ট গঠন
যুক্তফ্রন্টের কারণ
পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক দলগুলাে অত্যন্ত সুচিন্তিত মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে হারানাের লক্ষ্যে ১৯৫৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর, আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক দল, নেজামে ইসলামী দল একত্রিত হয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। পরবর্তীতে খেলাফতে রব্বানী, গণতন্ত্রিক দল যুক্তফ্রন্টে শরীক হয়। ঢাকার সদরঘাটের সিমসন রােডে যুক্তফ্রন্টের প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয়। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রতীক ছিল নৌকা। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, মাওলানা
আতাহার আলী, হাজী দানেশ প্রমুখ যুক্তফ্রন্টের প্রথম সারির নেতা ছিলেন। আর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানী শাসকগণ কর্তৃক শোষণ নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেলে উপরােক্ত নেতৃবৃন্দের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হয়ে পড়ে। তবে ১৯৫৩ সালের নভেম্বর মাসে ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে মুসলিম লীগ বিরােধী একটি জোট গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
আরোও দেখুনঃ গ্যাস্ট্রিক দূর করার উপায়
আরোও দেখুনঃ মহানবির (সা) রাজনৈতিক জীবন
আরোও দেখুনঃ বিপদ থেকে মুক্তি পেতে রাসূল ﷺ এর নীতিও আদর্শ
আরোও দেখুনঃ রক্তাক্ত প্রান্তর নাটকের কাহিনী
এ সময় পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজও যুক্তফ্রন্ট গঠনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল। পাকিস্তানী শাসকেরা যখন নির্বাচনের তারিখ ঘােষণা করেন তখন ছাত্রসমাজ পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃত্বের মধ্যে ঐক্য গড়ে তােলার চেষ্টা করেন। তারা বিভিন্ন স্লোগান নিয়ে এগিয়ে যায়। হক-ভাসানী-মুজিব-সােহরাওয়ার্দী এক হও’ – এ স্লোগানের মাধ্যমে তারা পূর্ব বাংলার নেতাদের একত্রিত করার চেষ্টা করেন।
আবার পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগও যুক্তফ্রন্টের গঠনের ব্যাপারে বিরােধী সকল রাজনৈতিক দলকে একত্রিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালের ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে ২১ দফার ভিত্তিতে অংশগ্রহণ করে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে হারিয়ে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের ৩০৯টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন লাভ করে এবং ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি আসন লাভ করে। নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন করে।
একুশ দফা কর্মসূচি
১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের মূল ভিত্তি ছিল ২১ দফা। একুশ দফা পূর্ব বাংলার জনগণ কর্তৃক ব্যাপক সমর্থন লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। একুশ দফা রচনার মুসাবিদা রচনা করেছিলেন আবুল মনসুর আহমদ। যুক্তফ্রন্ট ২১ দফার ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিকে স্মৃতির পাতায় ধরে রাখার জন্য যুক্তফ্রন্ট তার নির্বাচনি কর্মসূচিকে ২১ দফায় বিন্যস্ত করে। একুশ দফা কর্মসূচি ছিল নিম্নরূপ:
১. বাংলা_ভাষাকে_পাকিস্তানের_অন্যতম_রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা_দিতে_হবে।
২. ক্ষতিপূরণ ছাড়া জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করতে হবে এবং উদ্ধৃত্ত জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে।
৩. পাট ব্যবসায় জাতীয়করণ ও পাটের ন্যায্যমূল্য প্রদান করতে হবে।
৪. সমবায় কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে এবং কুটির শিল্পের বিকাশ সাধন করতে হবে।
৫.পূর্ব পাকিস্তানে লবণে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য লবণ শিল্পের বিকাশ সাধন করতে হবে।
৬. সেচ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৭. বাস্তুহারাদের পুনর্বাসনের জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৮. পূর্ব পাকিস্তানকে শিল্পায়িত করতে হবে।
৯. অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক_ প্রাথমিক শিক্ষার প্রবর্তন করতে হবে।
১০. সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বৈষম্য বিলােপ করতে হবে এবং মাতৃভাষা হবে শিক্ষার মাধ্যম।
১১. বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত সকল কালাকানুন বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলােকে পূর্ণবায়ত্তশাসন দিতে হবে।
১২. প্রাদেশিক ক্ষেত্রে ব্যয় সংকোচন করতে হবে। একক ও নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারীদের মধ্যে বেতন বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে এবং মন্ত্রিদের বেতন ১,০০০ টাকার বেশি হবে না।
১৩. সর্বস্তরে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি উচ্ছেদ করতে হবে এবং ঘুষ প্রথার বিলােপ সাধন করতে হবে।
১৪. সকল রাজবন্দিকে বিনা বিচারে মুক্তি দিতে হবে। বাক-স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
১৫. শাসন_বিভাগকে_বিচার_বিভাগ_হতে_পৃথক করে_ন্যায়বিচার_নিশ্চিত_করতে_হবে।
১৬. বর্ধমান_হাউসকে_বাংলা_ভাষা ও সাহিত্যের_ গবেষণাগারে_পরিণত_করতে_হবে।
১৭. বাংলা সাহিত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের পবিত্র স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য শহীদ মিনার স্থাপন করতে হবে।
১৮. একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস এবং সরকারি ছুটির দিবস হিসেবে ঘােষণা করতে হবে।
১৯. লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করতে হবে। নৌবাহিনীর সদর দপ্তর পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তর করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্রের কারখানা স্থাপন করতে হবে।
২০. যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা কোনােক্রমে আইনসভার আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি করবে না, সাধারণ নির্বাচনের ৩ মাস পূর্বে মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করবে এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করবে।
২১. আইনসভার কোনাে আসন শূন্য হলে তিন মাসের মধ্যে উপনির্বাচন করতে হবে এবং যুক্তফ্রন্ট প্রার্থীরা পর পর তিনটি উপনির্বাচনে পরাজিত হলে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করবে।
যুক্তফ্রন্টের একুশ দফার প্রতিটি দফা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এটি ছিল পূর্ব বাংলার জনগণের প্রাণের দাবি। পাকিস্তানী শাসকদের প্রতি জনগণের বিরূপ মনােভাবের পরিচয়ও এর মাধ্যমে ফুটে ওঠে। জনগণ এতদিন পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম সরকারের প্রতি যে ক্ষোভ ছিল তার জবাব দেয়ার একটি উপযুক্ত সুযােগ লাভ করে।
আরোও দেখতে পারেনঃ
[★★★] খাদ্যে ভেজালের কারণ ও প্রতিকার
[★★★] দুর্নীতি কী? দুর্নীতির কারণ ও প্রতিকার।
[★★★] জামা’আতে সালাত আদায়ের গুরুত্ব
[★★★] সালাতের গুরুত্ব ও পরিত্যাগকারীর পরিণাম
[★★★] অযূ ও ফরয গোসলের নিয়ম