খাদ্যে ভেজালের কারণ ও প্রতিকার

খাদ্যে ভেজাল

‘ভেজাল’ শব্দটি সাম্প্রতিককালে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র বহুল উচ্চারিত একটি শব্দ। উৎকৃষ্ট দ্রব্যের সাথে নিকৃষ্ট দ্রব্য মেশানােকেই ভেজাল বলে। সাধারণভাবে আমরা খাদ্যে ভেজাল বলতে বুঝি প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক

খাদ্যদ্রব্যে নিম্নমানের, ক্ষতিকর, অকেজো, অপ্রয়ােজনীয় এবং বিশুদ্ধ বা খাটি নয় এমন কিছু মেশানােকে বােঝায়। গুণগতভাবে নির্ধারিত মানসম্মত নয় এবং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এমন খাদ্যদ্রব্যকে ‘ভেজাল খাদ্য

মনে করা হয়। খাদ্যে ভেজাল একটি মারাত্মক সামাজিক অপরাধ । খাদ্যে ভেজাল নিয়ে সমস্ত বিশ্ববাসী আজ উদ্বিগ্ন। খাদ্যে ভেজালের সাথে লােভী ব্যক্তিরা সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু;

তারা জঘন্য অপরাধী এবং মানবতার শত্রু । রােগমুক্ত সুস্থ সুন্দর জীবনের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য ভেজাল প্রতিরােধে বিশ্বের সকল মানুষেরই সােচ্চার হতে হবে, প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে ।

খাদ্যে ভেজালের সাম্প্রতিক চিত্র :

বেঁচে থাকার জন্য আমাদেরকে কোনাে না কোনাে খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। বেঁচে থাকার জন্য এবং শারীরিক বিকাশের জন্য খাদ্য অপরিহার্য। কিন্তু ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে বিশ্বের কিছু দেশে বিশেষ করে বাংলাদেশে খাদ্যে ভেজালের ভয়াবহ চিত্র

আরও পড়ুনঃ  দুর্নীতি কী? দুর্নীতির কারণ ও প্রতিকার

[★★★]  2020 সালে সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কার জিতেছেন কে

[★★★]  ওয়েবসাইট থেকে অনলাইনে ইনকাম করার ৫ টি উপায়

[★★★]  রক্তাক্ত প্রান্তর নাটকের কাহিনী

প্রকাশিত হচ্ছে। মানুষ নামের কলঙ্ক কিছু অসাধু ব্যক্তি খাদ্যে ভেজালের সাথে যুক্ত। এমন কোনাে খাদ্যসামগ্রী নেই যাতে তারা ভেজাল মেশাচ্ছে না। চাল-ডাল-আটা-ময়দা আমাদের প্রধান খাদ্য। ভালাে চালের সাথে নিম্নমানের চাল মেশাচ্ছে। চালে পাথর ও বালি মেশাচ্ছে। চালের রং উজ্জ্বল করার জন্য ইউরিয়া ও অন্যান্য

ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশাচ্ছে বা তা দিয়ে শােধন করছে। বাজারের বেশির ভাগ ডালই ভেজাল ও খাওয়ার অনুপযােগী। ডালেও মেশানাে হয় ক্ষতিকর রং এবং মাইটক্সিন নামে বিষাক্ত কেমিক্যাল। আটা-ময়দাতেও

মেশানাে হচ্ছে ভেজাল, বিশেষ করে কাঠের গুড়াে। পাউরুটি, বিস্কুট এবং নুডুলস তৈরিতে ব্যবহৃত আটা-ময়দায় ভেজালের হার আরও বেশি।

বাজারে এখন যেসব মিনারেল ওয়াটার পাওয়া যায় তার ৯৫ ভাগই পানের অযােগ্য। বাজারে যে হরেক রকম ব্রান্ডের ফলের জুস পাওয়া যায় সেগুলাের প্রায় ৯৫ ভাগের মধ্যেই কোনাে ফলের রস নেই বলে পরীক্ষায়

প্রমাণিত হয়েছে। এছাড়া এসব জুস,জ্যাম, জেলিতে যে বিষাক্ত রং মেশানাে হয় তা কিডনি, লিভার ও পেটের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

আমরা ভাতে-মাছে বাঙালি’। অথচ যেভাবে মাছ টাটকা রাখার জন্য ফরমালিন মেশানাে হচ্ছে তা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। শুঁটকি মাছে পােকা যেন না ধরে সেজন্য ব্যবসায়ীরা কীটনাশক ও ডিডিটি ব্যবহার করছে। বাংলাদেশে প্রচুর শাক সবজি ও ফলমূল পাওয়া যায় । একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এগুলাে টাটকা ও

সতেজ রাখার জন্য এবং ফলমূলগুলাে পাকানাের জন্য ক্যালসিয়াম কার্বাইড ইথােপেনসহ বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করে থাকে। এগুলাে আমাদের কিডনি ও লিভারের ক্ষতি করছে, ক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলছে এবং অনেকেই অকালে চোখের দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলছেন।

আমাদের দেশের একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী খাবারের তেল, ঘি, ডালডা, বাটারওয়েল প্রভৃতিতে ভেজাল মেশাচ্ছেন। এগুলাে মুখে দিলেই বা এর ঘ্রাণ নিলেই বােঝা যায় এগুলাের প্রায় ৭০/৮০ ভাগই ভেজাল, খাওয়ার অনুপযােগী এবং স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। অনেকে মাছ, দুধ, মিষ্টি, ফল ইত্যাদিতে ফরমালিন মিশিয়ে এগুলাের পচন রােধ করার চেষ্টা চালায় ।

শুটকি মাছে অনেকে ক্ষতিকর কীটনাশক ডিডিটি মেশান। এমনকি অসাধু ব্যবসায়ীরা গুঁড়া মশলার সাথেও ইটের গুঁড়া এবং অনেক ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশাচ্ছেন, যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। বাজারে আয়ােডিনমুক্ত লবণ’ বলে যা বিক্রি হচ্ছে তার প্রায় ৯০ ভাগেই আয়ােডিন বলে কিছুই নেই। আয়ােডিনের

অভাবে তাই আমাদের দেশে গলগণ্ড রােগ বেড়ে চলছে। মানসিক প্রতিবন্ধীর সংখ্যা বাড়ছে। এছাড়াও আমাদের দেশে হােটেল রেস্তোরাগুলাের ভিতরের বিশেষ করে যেখানে খাবার তৈরি হয় সেখানকার চিত্র খুবই নােংরা ও অস্বাস্থ্যকর। এসব হােটেল রেস্তোরায় পচা, বাসি খাবার পরিবেশন করা হয় ।
খাবারে বিষাক্ত রং, রস ও কেমিক্যাল মেশানাে হয়। প্রায়ই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে দেখা যায় যে, ভ্রাম্যমাণ পরিদর্শক টিম হােটেলগুলােতে মরা মুরগি, পচা মাছ-মাংস ব্যবহার করতে দেখেছেন, শাস্তি দিয়েছেন। এমনকি এদেশে হােটেল-রেস্তোরাঁয়
কুকুরের মাংস পরিবেশনের সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে একাধিকবার।

খাদ্যে ভেজালের কারণ :

খাদ্যে ভেজাল দেয়ার পিছনে প্রধান কারণগুলাে হলাে নিম্নরূপ :
১. অসৎ উপায়ে অতি দ্রুত বড়লােক হবাব উদগ্র বাসনা,
২. অধিক মুনাফা লাভের আশা,
৩. অসৎ কাজে লিপ্ত হবার জন্য ধর্মভয় বা পরকালের শাস্তির কথা চিন্তা না করা,
৪. সমাজের কার কী ক্ষতি হলাে সে সম্পর্কে চিন্তা, দুঃখ বা অনুশােচনার অভাব,
৫. খাদ্যের পচন ঠেকানাের জন্য ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়ােগ,
৬. ফলমূল তাড়াতাড়ি পাকানাে ও রং সুন্দর করার জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার,
৭. খাদ্যের স্বাদ বা ফ্লেভার বাড়ানাে বা খাদ্যকে দৃষ্টিনন্দন করার জন্য ভেজালের মতাে নিকৃষ্ট পথ বেছে নেয়া,
৮. দেশে প্রচলিত আইনের অপ্রতুলতা এবং যে আইন বিদ্যমান রয়েছে তার যথােপযুক্ত ব্যবহার না করা,
৯. রং, কেমিক্যাল ও কীটনাশকের অবাধ ব্যবহার,
১০. সচেতনতার অভাব।

খাদ্যে ভেজালের প্রতিকার :

খাদ্যে ভেজাল প্রতিকার বা প্রতিরােধে নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে :

১. খাদ্য উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলােকে তাদের উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী BSTI-এর দ্বারা মানােত্তীর্ণ হবার সার্টিফিকেট অর্জন এবং তা প্রদর্শন করতে হবে,
২. BSTI-এর দ্বারা পরীক্ষিত নয় এমন উৎপাদিত খাদ্যসামগ্রী বাজারজাত করা হলে সেজন্য কঠিন শাস্তির বিধান এবং তা কার্যকর করতে হবে,
৩. হােটেল রেস্তোরায় পচা-বাসি খাবার যেন পরিবেশন না করা হয় সেজন্য নজরদারি জোরদার করতে হবে। শুধু ঢাকা বা বড় বড় শহর নয়, দেশের সর্বত্র এজন্য ভ্রাম্যমাণ আদালতের তৎপরতা বাড়িয়ে দিতে হবে,
৪. অসৎ ব্যবসায়ী, উৎপাদক,পরিবেশকদের বিরুদ্ধে কী শাস্তি প্রদান করা হলাে, ভ্রাম্যমাণ আদালত কী করছে তা নিউজ এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশ ও প্রচার করতে হবে,
৫. চাল-ডাল-আটা-ময়দা, ফলমূল প্রভৃতির আড়তগুলােতে নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে এবং অসৎ ব্যবসায়ীদের শাস্তি প্রদান করতে হবে,
৬. বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ বাজারজাতকরণ ও বিপণন ব্যবস্থার সাথে জড়িতদের ওপর সতর্ক নজরদারি রাখতে হবে যেন এসব পদার্থ খাদ্যে ভেজালের জন্য নয় বরং উপযুক্ত কাজেই শুধু ব্যবহার হয়,
৭. খাদ্যে ভেজাল একটি ঘৃণ্য অপরাধ। এজন্য কঠোর আইন প্রবর্তন এবং তার যথাযথ প্রয়ােগ ঘটাতে হবে,
৮. খাদ্যে ভেজাল গােটা জাতিকে ধ্বংস করছে। এ থেকে উৎপাদক, পরিবেশক, ব্যবসায়ী কেউ নিস্তার পাচ্ছে না। কাজেই খাদ্যে ভেজালের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে প্রচার-প্রচারণা জোরদার করতে হবে,
৯. খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, খাদ্যপণ্য সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সােচ্ছার হতে হবে,
১০. খাদ্য সংরক্ষণের জন্য জনগণবান্ধব এবং স্বাস্থ্যসহায়ক উপায় বা পদ্ধতির উদ্ভাবন করতে হবে,
১১. জনগণ নিজেই যেন ফরমালিনমুক্ত বা ভেজাল পণ্য চিনতে পারে সে পদ্ধতি প্রচার করে জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে।
১২. খাদ্যপণ্য উৎপাদন থেকে ভােক্তার হাত পর্যন্ত তা পৌছানাের স্তরগুলােকে পরিদর্শনের আওতায় আনা,
১৩. ব্যবসায়ী সংগঠনগুলাের ভেজাল প্রতিরােধ সক্রিয় ভূমিকা পালন।