দুর্নীতি কি
দুর্নীতি একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি।সাধারণভাবে দুর্নীতি বলতে ঘুষ লেনদেন, প্রতারণা, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদিকে বােঝায়। সাম্প্রতিককালে ‘দুর্নীতি’ বিষয়টি সমগ্র বিশ্বে বহুল আলােচিত। দুর্নীতির কারণে পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে এবং হচ্ছে।
তবে দুর্নীতির বিষয়টি নিয়ে অতীতেও আলােচনা ছিল । কৌটিল্য প্রায় দু’হাজার বছর আগে তাঁর ‘অর্থশাস্ত্রে দুর্নীতি নিয়ে আলােচনা করেছিলেন। শেকসপীয়ার তার অনেক নাটকে দুর্নীতির বিষয়টি তুলে ধরেছেন।
তবে ‘দুনীতি’ বিষয়টি বর্তমান সময়ে সবাইকে সব থেকে বেশি ভাবিয়ে তুলেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল’ মনে করে “সমকালীন বিশ্বের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দুনীতি। এটি সুশাসনকে দুর্বল করে, সরকারি নীতিসমূহকে কলুষিত করে, সম্পদের অসম বণ্টন ঘটায় এবং বেসরকারি খাতকে বিশেষ করে দরিদ্র জনগণের দুর্ভোগ বাড়ায়।”
দুর্নীতি অর্থ কী এবং সংজ্ঞা
‘দুনীতি’ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলাে Corruption. শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ Corruptus থেকে, যার অর্থ ধ্বংস বা ক্ষতিসাধন। দুনীতি’ নেতিবাচক শব্দ। আভিধানিক অর্থে দুর্নীতি হলাে নীতি বিরুদ্ধ আচরণ । Social workDictionary-তে দুনীতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, “রাজনৈতিক ও সরকারি প্রশাসনে ঘুষ, বল প্রয়ােগ, ভয় প্রদর্শন, প্রভাব বিস্তার, ব্যক্তিবিশেষকে বিশেষ সুযােগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং এসবের মাধ্যমে ব্যক্তিগত সুবিধা গ্রহণকেই দুর্নীতি বলে”।
আরোও পড়ুনঃ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও ১১ দফা নিয়ে যত কথা
জাতিসংঘ প্রণীত Manual on Anti-Corruption Policy-তে বলা হয়েছে যে, ‘ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ক্ষমতার অপব্যবহারই দুনীতি। রােজ আকারম্যান (Rose Ackerman) “দুর্নীতি হলাে ঘুষের বিনিময়ে যেরূপ সুবিধা পাওয়া যা এটা ছাড়া পাওয়া যেতনা।
” কলিন নাই (Colin Nye)-এর মতে “দুর্নীতি হলাে সেই আচরণ যা ব্যক্তিগত সম্পদ বা মর্যাদা অর্জনের লক্ষ্যে সরকারি ভূমিকা পালনকারীর (নির্বাচিত বা মনােনীত) আনুষ্ঠানিক কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে বিচ্যুতি ঘটায়।” ভারতীয় সমাজবিজ্ঞানী রামনাথ শর্মার মতে, ‘অবৈধ সুযােগ-সুবিধা গ্রহণের জন্য কোনাে ব্যক্তির নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনে স্বেচ্ছাকৃত অবহেলাই হচ্ছে দুর্নীতি’ ।
Asian Development Bank-এর মতে, ‘দুর্নীতি হলাে সরকারি ও বেসরকারি পদে অধিষ্ঠিত থেকে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়া’। দুর্নীতির দুটি সুন্দর সংজ্ঞা প্রদান করেছে বাংলাদেশ ‘দুর্নীতি দআবন কমিশন (দুদক)। দুদক প্রকাশিত একটি হ্যান্ড ব্রুশিয়ারে দুর্নীতি কাকে বলে প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, ব্যক্তি স্বার্থ অর্জনের বা ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্যে অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহারই দুর্নীতি’।
একই ব্রুশিয়ারে দুদক প্রদত্ত দ্বিতীয় সংজ্ঞাটিতে বলা হয়েছে যে, “যে কর্মকাণ্ড সাধারণভাবে বিবেকের কাছে গ্রহণযােগ্য নয়, তাকেই দুর্নীতি বলা হয়।” সুতরাং দুর্নীতি বলতে শুধু ঘুষ গ্রহণকেই বােঝায় না। ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হবার চেষ্টা, স্বজনপ্রীতি, অন্যায় আচরণের পৃষ্ঠপােষকতা বা সমর্থন প্রদান ইত্যাদিও দুর্নীতি।
উপরের সংজ্ঞাগুলাে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করলে নিম্নলিখিত কাজগুলােকে দুর্নীতি বলা যায় :
১. ঘুষ গ্রহণ,
২. অর্থ বা সম্পদ আত্মসাৎ,
৩. ক্ষমতার অসাধু অপব্যবহার,
৪. ভীতি প্রদর্শন করে অর্থ-সম্পদ আদায় বা সুযােগ সুবিধা গ্রহণ,
৫. প্রতারণা, ৬. স্বজনপ্রীতি,
৭. রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার,
৮, সরকারি সম্পদ
ক্রয়-বিক্রয়ে অসচ্ছতা,
৯. দায়িত্ব পালনে অবহেলা,
১০. অসৎ উদ্দেশ্যে প্রভাব বিস্তার,
১১. ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের জন্য অন্যের ওপর মানসিক নির্যাতন চালানাে।
দুর্নীতির প্রভাব বা ক্ষতিকর দিক :
দুর্নীতির ক্ষতিকর দিক একাধিক। এগুলাে হলাে :
১. দুনীতি জনগণের দুর্ভোগ বাড়ায়,
২. দুর্নীতি জাতীয় উন্নয়নের অন্তরায়,
৩. দুর্নীতি দারিদ্র্যের মূল কারণ,
৪. দুনীতি সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে,
৫. দুর্নীতি জাতীয় সংহতি বিপন্ন করে,
৭. দুর্নীতির ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ে,
৮. দুর্নীতির ফলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় হয়,
৯. দুর্নীতির ফলে একশ্রেণির মানুষ রাতারাতি সম্পদের পাহাড় গড়ে তােলায় সামাজিক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়,
১০. সরকারি নীতিসমূহকে কলুষিত করে,
১১. জাতীয় সম্পদের অসম বণ্টন ঘটায়।
দুর্নীতির কারণ
একাধিক কারণে দুর্নীতি সংঘটিত হয়। এগুলাে নিম্নরূপ :
১. রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতার অভাব,
২. রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনাকারীদের জবাবদিহিতার অভাব,
৩. জনপ্রশাসনে অবাঞ্চিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ,
৪. আমলাদের প্রভুসুলভ মানসিকতা ও ক্ষমতার বাড়াবাড়ি,
৫. আমলাদের দায়িত্বে অবহেলা ও দক্ষতার অভাব,
৬. আমলাদের মেধা ও গুণগত মানের নিম্নগামিতা,
৭. উচ্চাভিলাষ ও ভােগ প্রবণতা বৃদ্ধি,
৮. আয়-ব্যয়ের অসামঞ্জস্যতা,
৯. বেকার যুবকদের ঘুষ প্রদান করে চাকরি লাভে মরিয়া হয়ে ওঠা,
১০.অর্থ সম্পদ সামাজিক মান-মর্যাদা পরিমাপের মাপকাঠি হওয়া,
১১. প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতি,
১২. আইনের যথাযথ প্রয়ােগ না হওয়া,
১৩. নৈতিক শিক্ষার অভাব,
১৪. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা,
১৫. আর্থিক অস্বচ্ছলতা ও জীবনযাত্রার নিম্নমান ।
দুর্নীতি প্রতিরােধের উপায় :
নিম্নলিখিত উপায়ে দুর্নীতি প্রতিরােধ করা যেতে পারে :
১. স্বাধীন, যথার্থ ক্ষমতাসম্পন্ন ও সক্রিয় দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা,
২. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা,
৩. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা,
৪. ন্যায়পালের পদ সৃষ্টি এবং দায়িত্ব অর্পণ করা,
৫. প্রশাসনিক জবাবদিহিতার নীতি কার্যকর করা,
৬. দক্ষ, নিরপেক্ষ প্রশাসন গড়ে তােলা,
৭. সরকারের দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক মানসিকতা সৃষ্টি,
৮. ধর্মীয় অনুশাসন ও নৈতিক মূল্যবােধ সৃষ্টি,
৯. সামাজিক চেতনা সৃষ্টির জন্য কার্যকর কর্মসূচি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন,
১০. দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টি এবং রুখে দাঁড়ানাে,
১১. দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করা,
১২. দুর্নীতি প্রতিরােধে দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার ঘােষণা ও তা বাস্তবায়ন,
১৩. সরকারের সুদৃঢ় ও সময়ােপযােগী কর্মকৌশল গ্রহণ,
১৪. রাজনৈতিক দল কর্তৃক সৎ, যােগ্য ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিদের নির্বাচনে মনােনয়ন প্রদান,
১৫. রাজনৈতিক দল পরিচালনায় অসৎ উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহ না করা,
১৬. জাতীয় সংসদ অর্থাৎ আইনসভাকে কার্যকর ও গতিশীল করে তােলা,
১৭. জাতীয় সংসদের কমিটিগুলােকে বিশেষ করে সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিকে দুর্নীতি প্রতিরােধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ক্ষমতাসম্পন্ন করে তােলা,
১৮. সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বাজার মূল্যের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে বেতন কাঠামাে নির্ধারণ ও অন্যান্য সুযােগ-সুবিধা প্রদান করা,
১৯. দূতবাজদের ঘৃণা করা এবং তাদের সম্পর্কে দুর্নীতি দমন কমিশনকে অবহিত করা,
২০. নাগরিক অধিকার সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা,
২১. সকল নাগরিকের এ মর্মে প্রতিজ্ঞা করা যে, দুর্নীতি করবাে না, দুর্নীতি মানবােনা এবং দুর্নীতি সইবাে না,
২২. দুর্নীতি থেকে প্রতিকার পাবার জন্য প্রয়ােজন কঠোর রাজনৈতিক অঙ্গীকার,
২৩. দুর্নীতি প্রতিরােধ করার জন্য গণমাধ্যমের সজাগ ও সচেতন ভূমিকা পালন,
২৪. রাজনৈতিক অঙ্গীকার,
২৫. প্রয়ােজনীয় আইন প্রণয়ন ও তা প্রয়ােগ করা,
২৬. সরকারি নিরীক্ষক কমিটি গঠন।
বাংলাদেশে দুর্নীতির চিত্র :
বাংলাদেশে দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে ব্যাপকভাবে। দেশে-বিদেশে এজন্য আমাদের দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হচ্ছে। দুর্নীতি বিরােধী আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল’-এর দুর্নীতি বিষয়ক গবেষণা জরিপে পর পর কয়েক বছর বাংলাদেশকে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
এছাড়াও বিশ্বব্যাংক, ইউএনডিপি, জাতিসংঘ বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক অনেক সংগঠন তাদের সাম্প্রতিক রিপাের্টগুলােতে বাংলাদেশের দুর্নীতি বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। শ্বিব্যাংকের Country Procurement Assessment সম্পর্কিত সাম্প্রতিক এক রিপাের্টে বলা হয়েছে যে,
সরকারি অফিসে ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়ে না । ঘুষ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেন এটা বেতনের অংশ হয়ে গেছে। ঘুষ না দিলে কোনাে কাজ হয় না, ঘুষ না পেলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাজে উৎসাহ পায় না।
ডেমােক্রেসি ওয়াচ’ নামক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান তাদের ২০০০ সালে প্রকাশিত রিপাের্টে বলেছে যে, দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষ মনে করে যে, পুলিশ সব থেকে দুনীতিপরায়ণ। একই ধারণা পােষণ করে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও। এছাড়াও তাদের রিপাের্টে শিক্ষাখাত, স্থানীয় সরকার খাত, স্বাস্থ্যখাত, বন ও পরিবেশ খাত প্রভৃতিতে দুর্নীতির হতাশাব্যঞ্জক চিত্র ফুটে উঠেছে।
বাংলাদেশ এখনাে একটি দরিদ্র দেশ। দারিদ্র্য এদেশের জনগােষ্ঠীর বৃহৎ অংশকে এখনাে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য করছে। বিদেশি সাহায্য এনে আমাদের উন্নয়নের চাকা সচল রাখতে হয়। অথচ সেই প্রাপ্ত সাহায্য যদি দুর্নীতিগ্রস্ত
লােকদের পকেটস্থ হয় তাহলে এদেশের উন্নয়ন কোনােদিনই হবে না। এজন্য এ মুহূর্তে সবার মনেপ্রাণে এ শপথ গ্রহণ করতে হবে যে, আমরা দুনীতি করবােনা, দুনীতি মানবােনা, দুনীতি সইবােনা।
আশার কথা এই যে, ২০০৪ সালের ৯ মে থেকে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন কার্যকর হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ উক্ত আইনের ৩৪-এ ধারা প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। একজন চেয়ারম্যান ও দুজন
কমিশনার নিয়ে গঠিত দুনীতি দমন কমিশন কার্যালয় ঢাকার সেগুনবাগিচায় অবস্থিত । এ সংস্থার লক্ষ্য হচ্ছে দেশে দুর্নীতি ও দুনীতিমূলক কাজ প্রতিরােধ করা। যে কোনাে ব্যক্তি অথবা সংস্থার বিরুদ্ধে কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত বিষয়ে কোনাে অভিযােগ সমন্বিত জেলা কার্যালয়, বিভাগীয় কার্যালয় অথবা সেগুনবাগিচা, ঢাকাস্থ প্রধান কার্যালয়ে প্রেরণ করা যাবে।
[★★★] 2020 সালে সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কার জিতেছেন কে
[★★★] ওয়েবসাইট থেকে অনলাইনে ইনকাম করার ৫ টি উপায়
[★★★] রক্তাক্ত প্রান্তর নাটকের কাহিনী