ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও ১১ দফা

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও ১১ দফা নিয়ে যত কথা

পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের দুটি গ্রুপ এবং জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের একাংশ নিয়ে ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ৫ জানুয়ারি একটি ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ (Student Action Committee – SAC) গঠিত হয়। দেশে যখন নেতৃত্বের অভাব, ঠিক তখনই “ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ” আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করে। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্য এ সংগ্রাম পরিষদ তাদের ১১ দফা কর্মসূচি ঘােষণা করে। আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচিকেও এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা ও ৬ দফা দাবির ভিত্তিতে ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ হলে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড গণ-অভ্যুত্থান দেখা দেয়।

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও ১১ দফা দাবির মূল বিষয়গুলাে ছিল নিম্নরূপ :

১। আত্মনির্ভরশীল কলেজগুলােকে প্রাদেশিকীকরণের নীতি প্রত্যাহার করতে হবে, জগন্নাথ কলেজকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। শিক্ষার ব্যাপক প্রসার। সরকারি কলেজসমূহে নৈশ বিভাগ খােলা। ছাত্রবেতন শতকরা ৫০ ভাগ হ্রাস, কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব; মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দান। ছাত্রদের আবাসিক ব্যয়ের শতকরা ৫০ ভাগ সাহায্য হিসেবে প্রদান। শিক্ষকদের বাকস্বাধীনতা দান ও বেতন বৃদ্ধি। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন। মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও মেডিকেল কাউন্সিল অর্ডিন্যান্স বাতিল। ছাত্রদের ট্রেন-বাসে ভ্রমণের সুবিধা দান। ছাত্রাবাসে উন্নত মানের খাবার ব্যবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স বাতিলকরণ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান। জাতীয় শিক্ষা কমিশন ও হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলকরণ ইত্যাদি।

২। প্রাপ্ত বয়স্কদের ভােটে প্রত্যক্ষ নির্বাচন ব্যাবস্থা ও পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র ব্যাবস্থা প্রবর্তন করা।৩। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা।
৪। পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষুদ্র প্রদেশগুলাের (সিন্ধু, লাহোর, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রভূতি) জন্য স্বায়ত্বশাসন ও একটি সাবফেডারেশন গঠন।
৫। ব্যাংক-বীমা,পাটের ব্যবসা ও বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ।
৬। কৃষকদের কর ও খাজনার পরিমাণ হার হ্রাস করা।
৭। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি প্রদান, বােনাস প্রদান, শিক্ষার অধিকার প্রদান, চিকিৎসা সেবা প্রদান, বাসস্থান এবং ধর্মঘট ও ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার প্রদান।
৮। পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং জনসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার।
৯। জরুরি ব্যবস্থামূলক আইন, নিরাপত্তা আইন এবং অন্যান্য দমনমূলক আইন বাতিলকরণ।
১০। সিয়াটো, সেনটো ও পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল এবং নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি গ্রহণ।
১১। ১৯৬৮ সালের আগরতলা মামলায় আটককৃত আসামীসহ সকল রাজবন্দীদের মুক্তি দান।

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা আন্দোলন শুধুমাত্র পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র আকার ধারণ করেনি, পশ্চিম পাকিস্তানেও এর ঢেউ লাগে। সেখানে আইয়ুব খান বিরােধী ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে। ১৮ জানুয়ারি থেকে ছাত্ররা তাদের ১১ দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। ঐদিন গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ (DAC) কর্তৃক আহূত হরতাল জনগণ তঃস্ফূর্তভাবে পালন করে। সরকার ১১ দফাআন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। ১৪৪ ধারা জারি করেও আন্দোলনের ধারাকে প্রতিহত করা যায়নি। পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। অতঃপর শুরু হয় ব্যাপক পুলিশী নির্যাতন। ছাত্র বিক্ষোভের তৃতীয় দিন অর্থাৎ ২০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র-জনতার উপর পুলিশের জুলুম চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে। ছাত্রদের একটি বিক্ষোভ মিছিলের উপর নির্বিচারে গুলি চালান হয়। পুলিশের গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদুজ্জামান নিহত হয়। আন্দোলনের গতি আরও তীব্র আকার ধারণ করে এবং গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। পুলিশ কর্তৃক ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সমগ্র প্রদেশে ধর্মঘট, মিছিল চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত গণবিক্ষোভকে দমন করার জন্য শাসকগােষ্ঠী সেনাবাহিনী তলব করে এবং বিভিন্ন জায়গায় কারফিউ (সান্ধ্য আইন) জারি করে। সেনাবাহিনী প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে গুলি চালিয়েও এ দুর্বার আন্দোলনকে স্তন্ধ করতে পারেনি। পশ্চিম পাকিস্তানেও এ সময় স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন আরও জোরদার হয় এবং সমগ্র দেশে অরাজকতা দেখা দেয়।

১১-দফা কর্মসূচির গুরুত্ব [Importance of 11 Points Programme]

সাবেক পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছাত্রসমাজের ১১-দফা কর্মসূচির গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
এ ১১-দফার ভিত্তিতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বিপ্লবী ছাত্রসমাজ ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারী শাসক
গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে এক অপ্রতিরােধ্য ও দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। ছাত্রসমাজ তাদের ১১-দফা এবং আওয়ামী লীগের ৬-দফার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে দেশব্যাপী এক প্রচণ্ড গণবিপ্লবের সৃষ্টি করে। এ গণ-বিপ্লবের গতি-প্রকৃতি লক্ষ্য করে ক্ষমতাসীন পাকিস্তান সরকার দিশাহারা হয়ে পড়ে। উপায়ান্তর না দেখে সাবেক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সকল বিরােধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের এক

আরও পড়ুনঃ বিসিএস প্রিলি আন্তজার্তিক শর্ট সাজেশন

বৈঠকে আহবান করেন। এ বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল দেশব্যাপী আন্দোলন কীভাবে প্রতিহত করা যায়।
ইতােমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র ছাত্র-জনতা, কৃষক-শ্রমিক আইয়ুব খান এবং তার শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে। সমগ্র দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান মামলা প্রত্যাহার করেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল রাজনৈতিক নেতাদের বিনাশর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। এমতাবস্থায় ১১-দফা দাবির ভিত্তিতে আন্দোলন দুর্বার গতি লাভ করে অগ্রসর হতে থাকে।

জনপ্রিয় সার্চঃ

স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়
এগারো দফা কখন ঘোষণা করা হয়
৬ দফা বাঙালির মুক্তির সনদ রচনা
১১ দফা আন্দোলন ক্রিকেট
১১ দফা আন্দোলন করা হয় কেন