অনুবর্তন বই রিভিউ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

অনুবর্তন বই রিভিউ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রথম বিভূতিভূষণ ধরে যখন ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ পড়ি, বেশ কিছুক্ষণ একটা ধন্দে জমাট বেঁধে ছিলাম। কাহিনিটা আসলে কার? একটা একটা করে নতুন চরিত্র আসে আর আমি তাকে আঁকড়ে ধরে গল্পে আগাতে চেয়ে একটু পরেই ঘোল খাই। মোটামুটি গোটাবিশেক পৃষ্ঠা পড়ার পর বোধহয় স্থির হই দিশা পেয়ে।
‘অনুবর্তন’ পড়তে গিয়েও একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি এবং বলাবাহুল্য, এমন অভিজ্ঞতা একটুও বিরক্তি উৎপাদন করে না। বিভূতিভূষণের উপন্যাসের প্রতিটি আলাদা গল্পের শুরুতে কৈশোরের প্রথম প্রেমের শিহরণের মতো কিছু একটা অদ্ভুতদর্শন ভালোলাগার ধ্রুব উপস্থিতি বোধকরি পাঠ্যসুখ বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে।

শিরোনামঃ অনুবর্তন বই রিভিউ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

বই অনুবর্তন
লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
ধরন উপন্যাস
বিষয় মাস্টারদের কাহিনি
প্রকাশক মাটিগন্ধা
পেজ ১৬০
রিভিউ লেখক রেজওয়ান আহমেদ

📙📙 অনুবর্তন কাহিনী 
‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ যেমন পুরোভাগে জীবনধর্মী লেখা, ‘অনুবর্তন’ও উপজীব্য বিবেচনায় অবিকল তা-ই। মৌলিক পার্থক্যের জায়গাটা বোধকরি দুটো লেখার চরিত্রায়ণে। সোজা করে বলি – ‘অনুবর্তন’ ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’-এর মতো একক চরিত্রনির্ভর উপন্যাস নয়। ‘অনুবর্তন’-এর চরিত্রগুলোর প্রায় সবই প্রয়োজনীয় রকমের বিকাশ পেয়েছে। তবুও যদি প্রশ্ন হয় ‘অনুবর্তন’ কার গল্প, কীসের গল্প ইত্যাদি, তবে উত্তরে বলা যেতে পারে শিক্ষকদের গল্প, একটা স্কুলের গল্প ইত্যাদি।

দেবদাস বই রিভিউ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

বিভূতিভূষণ লিখেছেন –

“তবে স্কুলমাস্টার হিসেবে ইহাদের দৃষ্টি সংকীর্ণ, জীবনের পরিধি সুপ্রশস্ত নয়, সুতরাং কথাবার্তা প্রতিদিন একই খাত বাহিয়া চলে। সাহেব আজ অমুক ঘণ্টায় অমুকের ক্লাসে গিয়া কী মন্তব্য করিল, অমুক ছেলেটা দিন-দিন খারাপ হইয়া যাইতেছে, ইত্যাদি।”

‘অনুবর্তন’-এর এ অংশে স্কুলশিক্ষকদের ব্যাপারে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য যথেষ্টই জীবনঘনিষ্ঠ হলেও, আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ অনেকটা এরকম বা এর কাছাকাছি কিছু হলেও, সম্পূর্ণ একমত হতে পারছি না। স্কুলমাস্টারদের মধ্যেও উদারমনা, কালাতিক্রমী আধুনিক ব্যক্তিত্ব রয়েছেন বটে, সংখ্যায় কম হলেও। উপন্যাসের রামেন্দুভূষণ দত্তগুপ্ত নামের শিক্ষকের কথা ভাবা যেতে পারে এ বিবেচনায়।

আধুনিকতার বিপরীতে সেকেলে শিক্ষকচরিত্র রয়েছেন নারাণবাবু। স্কুলের শুরু থেকে জড়িত এই প্রবীণ শিক্ষাবিদের চরিত্রে ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’-এর হাজারী চরিত্রের ছায়া স্পষ্ট দেখেছি তাঁর স্নেহপরায়ণ ব্যক্তিত্বে। হোটেলের ভোক্তাদের জন্য যেমন হাজারী ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ, ছাত্রদের জন্য সেরকম প্রাণনিবেদন করেছেন নারাণবাবু। তাঁর চরিত্রে জড়িয়ে গেছে বিশেষত নিভাননী এবং চুনি চরিত্রদুটো।

‘অনুবর্তন’ উপন্যাসে নারী চরিত্রের খুব একটা বিকাশ কী কারণে জানি না, বিভূতিভূষণ ঘটাননি। ঘটালে নিভাননী, অনিলা, মিস্ সিবসন চরিত্রগুলোর যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। বিশেষত নিভাননী এবং সিবসন চরিত্রের অপচয়ই হয়েছে বলতে হবে। নিভাননীর মধ্যে অনেক খুঁজেপেতেও ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’-এর কুসুমকে পাওয়া গেল না। অথচ খানিকক্ষণের জন্য হলেও অনিলা আর ক্ষেত্রবাবুর প্রেমভাবের জায়গাটিতে ‘বিপিনের সংসার’ উপন্যাসের বিপিন আর মানীর প্রেমের কথা মনে পড়েছে। এদের পরিণয়ে চরিত্র দুটিতে নতুন মোড় আসে। তাতে মোটামুটিভাবে বলা যেতে পারে বাঙালি নারীচরিত্রের নির্মাণবৈচিত্র্যে এ উপন্যাস বিভূতির অপরাপর উপন্যাস থেকে আলাদা। যদুবাবুর স্ত্রীর চরিত্রটির ব্যাপারেও একইরকম হতাশা প্রযোজ্য। নারীচরিত্রের কলিগুলো ফুটতে ফুটতে ঝরে গেছে যেন।

ক্ষেত্রবাবু যখন বিয়ে করেন অনিলাকে, তারপর একজন স্কুলশিক্ষকের জীবনে প্রকৃতপক্ষে প্রেমের সংসার করবার সময় বা অবস্থা থাকে না। উপন্যাসে এ সহজ সত্যটি খুব সচেতনভাবেই বজায় রাখবার প্রবণতা দেখা গেছে।

দু’অনুচ্ছেদ আগেই চুনির কথা বলছিলাম। মডার্ন ইনস্টিটিউশন স্কুলের ছাত্রটি নারাণবাবুর টুইশানির ছাত্রও বটে। তাঁর বৃদ্ধ বয়সের সঙ্গী বলতে এরকম ছাত্রেরা। বিশেষত চুনির কথা উপন্যাসে গুরুত্বের সাথে এসেছে। স্কুলের অনিয়মিত, অনিশ্চিত বেতন ব্যবস্থার জেরে জীবনের খরচ সংগ্রহে টুইশানি করতে হয় সকলকেই। সেসকল ছাত্রের বাসায় এমন শিক্ষকদের বিড়ম্বনাই পেতে হয়েছে বেশি। সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে সমানুপাতে। ছাত্রের অভিভাবক ও শিক্ষকের এহেন পারস্পরিক চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্বের ব্যাপারটি চিরকালীন। আজকের সমাজেও টুইশান মাস্টাররা সমান অবহেলার শিকার। সমকালীন লেখায় দেখি রবিউল করিম মৃদুলের ‘হত্যার শিল্পকলা’ উপন্যাসে মাসের বহুদিন চলে গেলেও সন্তানের মাস্টারকে বেতন দেওয়ার খবর নেই। ‘অনুবর্তন’ দেখিয়েছে যদুবাবু এক মাসের টুইশানের টাকা পরের মাসেও না পাওয়ার মর্মে কথা-কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়ছেন ছাত্রের বাপের সাথে।

বিপরীত চিত্রও দেখেছি আবার সমকালীন উপন্যাস ‘করুণাহীন করোনার দিন’ (ওয়াদুদ খান) পড়তে গিয়ে। বঙ্গদেশে প্রাইভেট মাস্টার যে কখনো সখনো ভালো আচরণও পান, সে বিষয়টি আজাদ চরিত্রে দেখেছি। বিভূতিভূষণ উপন্যাসের এক জায়গায় লিখেছেন –

“ইহারা অল্পেই সন্তুষ্ট, অভাবের মধ্যে সারা জীবন এবং যৌবনের প্রথম অংশ অতিবাহিত করিয়া সংযম ও মিতব্যয়ে অভ্যস্ত হইয়া উঠিয়াছেন।”

চাঁদের পাহাড় pdf রিভিউ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

এই যে অভাবচিত্র, মিতব্যয়-সংযমের বোধ তাতে কখনো সখনো ঢাকা পড়ে যায়। এ বিষয়টি যদুবাবুর চরিত্রের চিত্রায়ণে ভাষা পেয়েছে উপন্যাসে।

কীভাবে?

চুরি মানুষের ভেতরকার একটা সুপ্ত প্রবৃত্তি। নীতিনৈতিকতার অবকাশ আর থাকে না যখন অভাব আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরে মানুষকে। সে কারণেই বলা হয়ে থাকে – অভাবে স্বভাব নষ্ট।
‘অনুবর্তন’ পাঠকালে যদুবাবুর মধ্যে যে চুরির প্রবণতা দেখেছি, তা মূলত বঞ্চনাপ্রসূত দারিদ্র্যের ফলে তাঁর মধ্যে এসেছে। তিনি স্কুলের বাচ্চাদের শিক্ষাসফরের ফান্ড থেকে টাকা চুরি করেন, আবার বাচ্চাদের থেকে কৌশলে চাঁদা তুলে সেখান থেকেও টাকা চুরি করেন। এসব ফিকির করে যে তিনি ধরা পড়েন না, এমনও নয়। ছাত্রদের টিফিন থেকে বড়োসড়ো চুরি করে তিনি নাস্তার খরচ বাঁচিয়ে নিয়েছেন নিজের। শেষদিকে তাঁর মধ্যে এসব ব্যাপারে অনুশোচনা দেখা গেছে বটে।

আমরা ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসে কুবের এবং সিধুকে চুরি করতে দেখি অভাবে। আবার মানিকই স্বভাবের চোর বানিয়েছেন ‘চোর’ গল্পে। একজন আক্ষরিক চোর এবং একজন পরকীয়া-চোর চরিত্র নিয়ে জানা যায় সে গল্পে।

যা কিছুই অন্যত্র থাকুক না কেন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের নিয়মিত আয়-উপার্জনের যে সংকট, ‘অনুবর্তন’-এ সেটি বেশ স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এ ব্যাপারটি আজও অপ্রাসঙ্গিক নয়।

‘এক নম্বর মেসবাড়ি’। সম্ভবত নব্বইয়ের দশকের শেষভাগ কিংবা একবিংশ শতকের শুরুর দিককার একটা সিরিয়াল। ইটিভি বাংলায় দিত। সে সময় কস্মিনকালেও একটা পর্ব দেখা হয়ে ওঠেনি সে সিরিয়ালের। পরে বাংলাদেশি সিরিয়াল ‘ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ফ্যামিলি’তে মেসজীবনের খুঁটিনাটি যখন দেখেছি, তখন নিজেরও মেসজীবন চলছে।

‘শারদ নির্মুখোশ’ কলকাতার মেসবাড়ি প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ দলিল। বাংলাদেশে মেস বলতে ‘সরদার ভিলা’র নাম করে অনেকেই। নজরুলের লেখায় ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসে মেসজীবন এসেছে। হরিশংকর জলদাস ‘বাতাসে বইঠার শব্দ’ উপন্যাসে দেখিয়েছেন একটুকরো মেসজীবন। ‘অনুবর্তন’ উপন্যাসে যদুবাবুর মেসজীবনে ফ্রেন্ডচার্জ, ধারকর্য, ফিস্টসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মেসবিষয়ক সত্যের বিবরণ মোহিত করেছে বেশ!

করুণরস জাতীয় রচনায়ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় হাস্যরসাত্মক পরিবেশ তৈরি করতে পারেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় দুয়েক জায়গায় এমন দেখলেও বিভূতিকে এক্ষেত্রে তিনি ছাড়িয়ে যেতে পেরেছেন, এমনটা বলার সুযোগ নেই।

বাড়িভাড়া ফাঁকি দিয়ে অবনীর বাড়িতে কয়েকদিন থাকার পর বউকে সেখানে রেখে কলকাতায় ফিরে মেসে উঠবেন যদুবাবু – এই ছিল অবস্থা। যদুবাবুর আর্থিক দুর্গতির বিপরীতে বেড়াবাড়িতে তার আর অবনীর ভেতরকার ধনিক-দরিদ্র খেলায় হাস্যরস তৈরি হয়। ‘অশনি সংকেত’ উপন্যাসের গঙ্গাচরণের ঘটনায়ও এমন কারুণ্য আর হাস্যের যুগপৎ অস্তিত্বের কথা মনে পড়ে।

‘অনুবর্তন’ উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য চরিত্রের সকলেই প্রাপ্তবয়স্ক থেকে প্রৌঢ় এবং বৃদ্ধ। নিজেদের মধ্যে এঁদের গল্পগুজব বেশিরভাগই চায়ের দোকান আর স্কুলের টিচার্স রুম জুড়ে চলে। নিজেদের গল্পের বাইরেও এঁরা স্কুললাগোয়া আবাসিক ভবনের টুকরো গল্পের ধারক বটে। সেসব জায়গার লোকেদের দৈনন্দিন জীবনও এঁদের স্পর্শ করে। চুপিচুপি খবর রাখে এঁরা – কোন্ বাড়িতে কী হলো না হলো, যতদূর সম্ভব। এসব বিবরণে চোস্ত আভিজাত্য বজায় রেখেছেন বিভূতি নিজের কলমের। তবে, যৌনচেতনাপ্রসূত ঘটনার বিবরণে বিভূতিভূষণ যথেষ্টই হিসেবি। এ ব্যাপারটি ‘অনুবর্তন’-এর মতো ‘অশনি সংকেত’ দেখিয়েছে। দেখিয়েছে ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’।

বরিশালের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিবরণ ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসে নজরুলের কাছে পেয়েছি। তারপরও বিভূতিভূষণ যখন তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের দৃষ্টি দিয়ে বরিশাল নিয়ে দায়সারাভাবে লিখলেন, তখন ঈষৎ ক্ষুণ্ন হই।

প্রকৃতপক্ষে নারাণবাবুর চারিত্রিক বিশেষত্বই এক্ষেত্রে ঐ সামান্য বিবরণের কারণ হলেও একটা কীসের অতৃপ্তি পাঠকমনে কাজ করে।

কীর্তন গানের আসরের টানে প্রতিষ্ঠিত প্লেব্যাক শিল্পী মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় বরিশালে ছুটে আসতেন। উপন্যাসে নারাণবাবুর মধ্যকার সংকীর্ণ চিন্তাভাবনার এক প্রকারের শ্লেষাত্মক সমালোচনাই দেখি কীর্তনপ্রেমী পঞ্চানন চরিত্রের মাধ্যমে।

‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ উপন্যাসে মালিক-কর্মচারীর যে আদর্শিক দ্বন্দ্ব দেখি তা ‘অনুবর্তন’-এ নতুন মাত্রায় প্রকাশিত। মিঃ আলমের সাথে ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’-এর পদ্মঝি চরিত্রের গুরুত্বপূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক মিল স্পষ্ট। বিভূতিভূষণের লেখায় ‘বিপিনের সংসার’ উপন্যাসের নাম-ভুলে-যাওয়া একটা মুসলমান চরিত্রের কথা (আইনদ্দি সম্ভবত) মনে করে মিঃ আলম চরিত্রের গতিপথ ভাবিয়েছে বেশ।

যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যকার অন্তঃরাজনীতির যে স্নায়ুযুদ্ধ চলে, ‘অনুবর্তন’ উপন্যাসে তার নিয়ন্তাচরিত্র মিঃ আলম। পদ্মঝি ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ উপন্যাসে একই ধরণের ভূমিকায় অবতীর্ণ চরিত্র।

রামেন্দুভূষণ চরিত্রের স্পষ্টবাদিতা ভালো লেগেছে অচলায়তনের মধ্যে। বিশেষত মিঃ আলমের চোখে চোখ রেখে কথা বলা কিংবা ক্লার্কওয়েল সাহেবের সাথেও সহজভাবে সত্য বলবার সাহস মুগ্ধ করার মতো।

আরও এখুনঃ দারবিশ বই রিভিউ- লতিফুল ইসলাম শিবলী

বাকি রইলো ক্লার্কওয়েল সাহেব। তাঁর চরিত্রটি ধূসরিত। সমগ্র উপন্যাসে পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখে এ চরিত্রটিই, এর উত্থান-পতন। যদুবাবু-ক্ষেত্রবাবুদেরকে স্কুলে প্রতিনিয়ত নিয়মের বেড়াজালে আটকে, বেতন দিতে ব্যর্থ হয়ে, খোলা দরজার ভয় দেখিয়ে সাদা চোখে সাক্ষাৎ যমদূতের রূপ ধারণ করে শুরু থেকে বিরাজমান চরিত্র ক্লার্কওয়েল। তাঁর বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া ষড়যন্ত্রের জায়গাটিতে গিয়ে বোঝা যায় ব্যক্তিত্ববান শিক্ষকের আদর্শে তিনি কতটা দীক্ষিত। বিভূতিভূষণ লিখেছেন –
“… আমি আপনাদেরও যেতে বলি নে। আমি ওসব জিনিসকে বড় ঘৃণা করি। এটা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, রাজনীতির আসর নয়। এর মধ্যে দল-পাকানো, ষড়যন্ত্র – এসবের স্থান নেই। না হয় চলেই যাব।”

পদ্মঝি-বেচু চক্কোত্তির ধারায় সৃষ্ট জুটি যদি ধরা যায় মিঃ আলম-ক্লার্কওয়েল সাহেবকে, তাহলে বেচু চক্কোত্তি আর ক্লার্কওয়েলের তুলনামূলক আলোচনার দাবি উঠতে পারে। সেক্ষেত্রে বলা যায় বেচুর চাইতে বেশি সুগঠিত এবং বিকশিত চরিত্র ক্লার্কওয়েল সাহেব।

উপন্যাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রাখাল মিত্তির। লেখক সমাজের দারিদ্র্য এ চরিত্রে তুলে ধরেছেন বিভূতিভূষণ। এ বিষয়ে উপন্যাসে এসেছে –

“এইবার ক্ষেত্রবাবু ঘরের ভিতরটা স্পষ্ট দেখিতে পাইলেন। ওই যে রাখালবাবু তাকিয়া ঠেস দিয়া মলিন বিছানায় কাত হইয়া আছেন, পাশে একটা ততোধিক মলিন লেপ, বিছানার এক পাশে দড়ির আলনাতে দু-চারখানা ময়লা ও আধময়লা কাপড় ঝুলিতেছে, বিছানার সামনে একটা তাক, তাকের উপর অনেক বই কাগজ। এক পাশে একটা হ্যারিকেন লণ্ঠন। দেওয়ালে কয়েকখানি সস্তা ধরণের ক্যালেন্ডার – বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তক বিক্রেতাদের নাম ও বিজ্ঞাপন ছাপানো। ঘরের আসবাবপত্রের বীভৎস দারিদ্র্যে গরিব স্কুলমাস্টার ক্ষেত্রবাবুও যেন শিহরিয়া উঠিলেন।”

ক্ষেত্রবাবু এবং যদুবাবু শিক্ষকজীবনের যথাক্রমে গর্ব এবং অপমানের দিকগুলোর অভিজ্ঞতা পেয়েছেন দুই ছাত্রের মাধ্যমে।

সুরেশ মুখার্জি চরিত্রটি স্কুল পাস করে বড়ো ইঞ্জিনিয়ার হয়েও নিজের শিক্ষকদের ভোলেনি।
বিভূতিভূষণ লিখেছেন –
“যুবকটি পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিয়া চলিয়া গেল। ক্ষেত্রবাবু সগর্বে একবার চারিদিকে চাহিলেন – লোকে দেখুক, এমন একজন স্যুট-পরা তরুণ যুবক তাঁহার পায়ের ধূলা লইতেছে।…”

আবার যুদ্ধপরিস্থিতিতে যদুবাবুর অভিজ্ঞতা এমন –

“প্রজ্ঞাব্রত চলিয়া গিয়া যেন হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল। দেখ দেখি বিপদ! যাইতেছি বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াইতে, রাস্তার মাঝখানে ডাকিয়া অনর্থক সময় নষ্ট – কে এখন বুড়োমানুষের সঙ্গে বকিয়া মুখ ব্যথা করে! মানুষের একটা কাণ্ডজ্ঞান তো থাকা দরকার, এই কি ডাকিয়া গল্প করিবার সময় মশায়?”

এই কথিত কাণ্ডজ্ঞানহীন বুড়োমানুষটি যদুবাবু।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরিস্থিতির আঁচ কলকাতা শহরে বেশ লেগেছিল। এ প্রসঙ্গে ‘অশনি সংকেত’ আবার উল্লেখযোগ্য। গ্রামীণ পরিবেশের সে লেখাটিতে দেখি আমরা, গ্রামের স্বল্প শিক্ষিত লোক যুদ্ধ সম্পর্কে একবারেই অন্ধকারে। এদিকে কলকাতা থেকে যে যেদিকে পেরেছে পালিয়েছে সে সময়। এই ডামাডোলেই ক্লার্কওয়েল সাহেবের মডার্ন ইনস্টিটিউশন এক বড়দিনে বন্ধ হয়ে পরের গ্রীষ্মের আগে আর খোলেনি।

নারাণবাবু ত আগেই মারা গেছেন, যদুবাবুও আর বেঁচে থাকতে স্কুলের চাকরিতে ফিরতে পারেননি।

অল্পসংখ্যক ছাত্র নিয়ে আবার স্কুল খুলেছে বটে। স্বভাবসুলভ উন্মুক্ত সমাপ্তিতে আমরা কোনো দিশা পাইনি শেষমেশ কার কী দশা হলো।

আরও দেখুনঃ দি আইশ্যাডো বক্স বই রিভিউ

🔷🔷 পাঠ প্রতিক্রিয়া
ঘটনাক্রমে ‘আরণ্যক’-এর মতোই বুঁদ হয়ে ছিলাম ‘অনুবর্তন’-এ। ‘আরণ্যক’ বোধকরি বাঙলা সাহিত্যের অবশ্যপাঠ্য পাঁচ উপন্যাসের তালিকাভুক্ত একটি। সে বিবেচনায় ‘অনুবর্তন’ সেরা পঞ্চাশের তালিকায় নেই হয়তো। অথচ বিষয় বিবেচনায় ‘অনুবর্তন’ খুবই সমৃদ্ধ উপন্যাস।
এতটাই টেনেছে বিভূতিভূষণের লেখা, যে পাঁচ-ছ’বার করে একেক অনুচ্ছেদ পড়েও সাধ মিটবে না বলে মনে হয়েছে। এই উপন্যাসটা কী কারণে কম প্রচার পেল, বুঝতে পারছি না।

অনুবর্তন বই রিভিউ . অনুবর্তন বই। অনুবর্তন পিডিএফ। অনুবর্তন ডাউনলোড. অনুবর্তন উপন্যাস।

অনুবর্তন বই ডাউনলোড