মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী সমস্যা

মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী সমস্যা

মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী সমস্যা

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম দিক ছিল বাঙালিদের দেশত্যাগ। যাদের এক শব্দে ‘শরণার্থী’ বলে উল্লেখ করা হয়। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসরদের হত্যা, নিপীড়ন ও ধর্ষণ এড়াতে ২৬ মার্চ থেকে মানুষজন প্রথমে গ্রামে এবং তার পর সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে শরণার্থী হিসেবে গমন করে। শরণার্থী হিসেবে সীমান্ত অতিক্রম করার সময়ও অনেকে নিহত হন যাদেরকে গণহত্যার অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

শরণার্থী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করেছে। ১৯৪৭ সালের পর আর কখনাে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে এত মানুষ বাস্তুভিটা ত্যাগ করেনি। এর অনেকগুলাে দিক ছিল—

প্রথমত, বিপুল সংখ্যক শরণার্থী ভারতে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয় আরাে নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি করে। এ সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় ছিল পাকিস্তানের পরাজয় ও মুক্তিযুদ্ধের জয়। যে কারণে ভারত এর দ্রুত সমাধানের লক্ষ্যে চুড়ান্ত পর্যায়ে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে ভারতের পক্ষে শরণার্থীর চাপ সহ্য করা সম্ভব হতাে না এবং স্থায়ীভাবে সীমান্তে বিপুল পরিমাণ শরণার্থী রাখাও সম্ভব ছিল না। ত্রিপুরার মােট জনসংখ্যার সমান ছিল শরণার্থীর সংখ্যা। ভারত সরকারকে প্রতিদিন দুই কোটি টাকা শরণার্থীদের জন্য ব্যয় করতে হতাে।

দ্বিতীয়ত, প্রতিনিয়ত শরণার্থী সীমান্ত পাড়ি দেওয়ায় পাকিস্তান একথা প্রমাণ করতে পারছিল না যে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। ফলে বিশ্ব জনমত তার পক্ষে নেয়া সম্ভব হয়নি।

তৃতীয়ত, এই শরণার্থী সমস্যাকে প্রধান করে তুলে ভারত আবার বিশ্ব জনমতকে নিজের পক্ষে নিতে সক্ষম হয়েছিল।

👉 আরোও দেখুনঃ আশরাফ সিদ্দিকী কে জেনে নিন

👉 আরোও দেখুনঃ 2020 সালে সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কার জিতেছেন কে

👉 আরোও দেখুনঃ মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ইতিহাস

👉 আরোও দেখুনঃ রক্তাক্ত প্রান্তর নাটকের কাহিনী

বাংলাদেশের সীমান্তের মােট ৯৪ ভাগ ভারতের সাথে এবং ৬ ভাগ মিয়ানমারের সাথে। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু বাসিন্দা সীমান্ত পেরিয়ে মিয়ানমার গিয়েছিলেন কিনতু মিয়ানমার এই যুদ্ধ সহানুভূতির সঙ্গে দেখেনি। ভারতীয় সীমান্ত ছিল খােলামেলার পেরুনাে সহজ। আবার পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়ের মানুষজন সহযােগিতা ও বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। উভয় অঞ্চলের ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক মিল ছিল। অনেকের আত্মীয়স্বজনও ছিলেন ওপারে।

শরণার্থীদের স্রোত এপ্রিল থেকে প্রবল হয়ে ওঠে। কত শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তার সঠিক হিসাব না পেলেও ভারতীয় হিসাব অনুযায়ী সে সংখ্যা ছিল ৯৮,৯৯,৩০৫ জন। এটি হচ্ছে ক্যাম্পের হিসাব। কিন্তু ক্যাম্পের বাইরেও ছিলেন অনেক শরণার্থী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোনাে দেশ থেকে এতাে কম সময়ে এতা মানুষ শরণার্থী হননি। শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়া হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তর প্রদেশে। তবে চাপ বেশি ছিল পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায়। ভারত যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে শরণার্থীদের সাহায্য দেয়ার ও শান্ত রাখার।

মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী সমস্যা পরে

এক কোটি শরণার্থীকে স্বাভাবিকভাবেই মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়েছে। কলেরা ও অন্যান্য রােগে মারা গেছেন অনেকে। তবে শুধুমাত্র ভারত সরকার নয়, শরণার্থীদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ। যে যতটুকু পেরেছেন তা দিয়ে শরণার্থীদের সাহায্য করেছেন। অন্যদিকে, প্রবাসী বাঙালি ও বিশ্ববাসীও এগিয়ে এসেছিলেন শরণার্থীদের সাহায্যে। সে দানও ছিল অপ্রতুল। তা সত্ত্বেও বলতে হবে, ভারত সরকার, ভারতীয় জনগণ, প্রবাসী বাঙালি, জাতিসংঘ ও
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাধারণ মানুষ যদি শরণার্থীদের সাহায্যে এগিয়ে না আসতেন তবে ভারতের পক্ষে এককভাবে এ ভার বহন করা সম্ভব হতাে না এবং মৃত্যুর সংখ্যা যে আরাে বৃদ্ধি পেত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর শরণার্থীরা দেশে ফেরা শুরু করে।

তথ্যসূত্র
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস – সালাম, নাসির, নজরুল