ডাক ও খনার বচনের শ্রেণিবিভাগ
ডাক ও খনার বচনের শ্রেণিবিভাগ ‘ডাক ও খনার বচন’ এগুলাে প্রধানত নীতিমূলক। মানব জীবনের কতকগুলাে মৌলিক বিষয় নিয়ে রচিত এই বচনে প্রাচীন সমাজের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। এর সঙ্গে নিসর্গজ্ঞান যুক্ত হয়ে একই সঙ্গে ‘ডাক ও খনার বচন’ নামে লােকসমাজে প্রচলিত।
ডাক ও খনার বচনের দুটি অংশ :
ক. কৃষিকাজ, বৃষ্টিপাত, জলবায়ু সম্পর্কিত। প্রায়শই অভিজ্ঞতানির্ভর, বহুদর্শিতা প্রসূত।
খ.ফলিত জ্যোতিষ । এখানে প্রাকৃতিক ঘটনা, বার তিথি অনুযায়ী নানা ফল, যাত্রার শুভাশুভ ইত্যাদি নির্দেশ করা হয়েছে। সন্তান জন্ম, আয়ু, বৈধব্য, ভাগ্য, ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেখানে মানুষের জ্ঞান পৌছায় না সেখানে ভবিষ্যদ্বাণী করে মনে বল সঞ্চার করা হয়েছে। ড. সুশীল দে ডাক ও খনার বচনের মধ্যে তেমন কোনাে প্রভেদ উল্লেখ করেননি। তবে ড. আশুতােষ ভট্টাচার্য লক্ষ্য করেছেন কৃষিবিষয়ক ধ্যান-ধারণা খনার বচনে এবং আবহাওয়াবিষয়ক লােকজ্ঞানগুলাে ডাকের বচনে প্রাধান্য পেয়েছে। যদিও তিনি স্বীকার করেছেন এই বিভাজন চূড়ান্ত নয়।
ডাকের বচনগুলােকে সাধারণত জ্যোতিষ বচন বলা যায়। কিন্তু এই জ্যোতিষও শাস্ত্রীয় জ্যোতিষ নয়, বরং তার পরিবর্তে লৌকিক জ্যোতিষ। তবে খনার বচনের মধ্যেও কোনাে কোনাে সময় জ্যোতিষের কথা শুনতে পাওয়া যায়। অনেক সময়
এ গণনায় মিহিরের আয়ু ১০০ বছর। বরাহ মিহির একথায় প্রতীত হয়ে খনা ও মিহিরকে পুত্রবধূ ও পুত্র হিসেবে সানন্দে স্বগৃহে থাকতে দেন। অতঃপর, খনা বরাহ মিহিরের জ্যোতিষশাস্ত্রীয় বহু দুঃসাধ্য সমস্যা সমাধান করে দিতেন। খনার পাণ্ডিত্যের কথা জনশ্রুতিতে পরিণত হয় এবং মহারাজ বিক্রমাদিত্যের কর্ণগােচর হয়। তিনি খনাদেবীকে রাজসভায় দশম পণ্ডিত হিসেবে আসন দান করেন।
এতে অপমানিত ও ঈর্ষান্বিত পণ্ডিত বরাহ মিহির পুত্র মিহিরের সঙ্গে পরামর্শপূর্বক ঠিক করেন যে, জিহ্বা কর্তনপূর্বক পুত্রবধূকে বাকশক্তি রহিত করতে হবে। মিহির খনাকে একথা সবিশেষ জানান। খনা সানন্দে এ শাস্তি মেনে নেন। পিতৃ আদেশে মিহির এক তীক্ষধার ছুরিকা দ্বারা খনা দেবীর জিহ্বা কর্তন করেন। অতি মাত্রায় রক্তক্ষরণে অসামান্য বিদুষী খনার জীবন সাঙ্গ হয়। উড়িয়া ভাষায় প্রচলিত কিংবদন্তিতে দেখা যায়- রাজা বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার অন্যতম জ্যোতির্বিদ পণ্ডিত বরাহ মিহির স্বীয় নবজাত সন্তানের অকাল মৃত্যুর কথা ভুল গণনাবশতঃ জানতে পেরে নবজাতকে একটি ভাসমান বাক্সে পুরে স্রোতে ভাসিয়ে দেন।
এভাবে মৃত্যুর হাত থেকে নবজাতক পরিত্রাণ পেতে পারে, এমন একটি ধারণা হয়তাে পণ্ডিতের মনে ছিল। সে সময় অন্য একটি রাজ্যের অনিন্দ্য সুন্দরী শিশু রাজকুমারী দ্বীপবাসী তথাকথিত বিদ্রোহী রাক্ষসদের আক্রমণে সবংশে পিতৃমাতৃহীনা হয়ে রাক্ষস-কবলিত হন এবং তাদেরই আশ্রয়ে লালিত-পালিত হতে থাকেন। সেই অভাগী শিশু রাজকুমারীর নাম লীলাবতী।
খনা সম্পর্কে কিংবদন্তি
হনা লংকা দ্বীপে রাজকুমারী ছিলেন। লংকা দ্বীপবাসী তথাকথিত রাক্ষসগণ একদিন সবংশে তার পিতা-মাতাকে হত্যা করে এবং শিশু রাজকুমারী খনাকে হস্তগত করে। ঠিক একই সময়ে, উজ্জয়িনীর মহারাজ বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভায় প্রখ্যাত জ্যোতিষ পণ্ডিত বরাহ মিহিরের পরিত্যক্ত নবজাত পুত্রকে একটি ভাসমান তাম্র-পাত্র থেকে উদ্ধার করে দুটো শিশুকে রাক্ষসেরা একত্রে লালন-পালন করতে থাকে। উল্লেখ্য যে, উড়িয়া কিংবদন্তির বর্ণিত কারণেই বরাহ মিহির নবজাতক পুত্রকে একটি তাম্র-পাত্রে স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন।
খনা ও মিহির কালক্রমে জ্যোতিষশাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করেন এবং যৌবনে পরস্পর পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। একদিন খুনা ও মিহির গণনায় অবগত হলেন যে, মিহির উজ্জয়িনীর সভাপণ্ডিত বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহের পুত্র। এক শুভ মাহেন্দ্রক্ষণে উভয়ে রাক্ষস রাজ্যের অনুমতিক্রমে এবং একজন অনুচরের সহায়তায় ভারতবর্ষে যাত্রা করেন। উজ্জয়িনীতে এসে খনা ও মিহির পণ্ডিত বরাহ মিহিরের নিকট আত্মপরিচয় দান করেন। কিন্তু পণ্ডিত সে কথা বিশ্বাস করতে চান না, কারণ, তিনি গণনা দ্বারা জানতে পেরেছিলেন যে, দশ বছর বয়সেই মিহিরের মৃত্যু ঘটবে। খনা তখন, নিম্নবর্ণিত বচনটি উদ্ধৃতি দিয়ে শ্বশুরের ভুল গণনা প্রতিপন্ন করেন-
কিসের তিথি কিসের বার
জনম নক্ষত্র কর সার
কি করাে শ্বশুর মতিহীন
পলকে জীবন বারাে দিন ।