মুনীর চৌধুরীর সাহিত্য জীবন
সাহিত্যিক মাত্রই সচেতন শিল্পী। মুনীর চৌধুরী বাংলা সাহিত্যের একজন স্তম্ভপ্রতিম কথাশিল্পী। তাঁর সাহিত্য বিচারে এসেছে বাস্তব জীবনবােধ, সত্যোপলব্ধি ও মানবিক সহানুভূতি। এজন্য তাঁকে কথাসাহিত্যের এক বলিষ্ঠ উদ্গাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শওকত ওসমান (১৯১৯-১৯৯৮), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (১৯২২-১৯৭১), সরদার জয়েন উদ্দীন (১৯১৮-১৯৮৬) প্রমুখ লেখকদের মতে মুনীর চৌধুরীর পরিচিতি নতুন প্রজন্মের কাছে তেমন প্রকাশ পায়নি। যদিও ছােটগল্প ও প্রবন্ধ রচনার মধ্যদিয়েইবিচিত্র সৃষ্টিসমপ্রতিভা মুনীর চৌধুরীর সাহিত্যিক জীবনের উন্মষ। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের ফসল হচ্ছে ছােটগল্প । বাংলা কথাসাহিত্য উপন্যাসের পরেই মূলত এর স্থান। ছােটগল্পের আঙ্গিকপ্রকরণ ও বিষয়ের অভিব্যক্তির দিক বিশেষণ করে বলা যায়, ছােটগল্প রচনার ক্ষেত্রে মুনীর চৌধুরীর নিরতিশয় বৈচিত্র্যসন্ধানী প্রচেষ্টা তাকে এনে দিয়েছে সব্যসাচী লেখকের অভিধা। ছােটগল্প রচনার ক্ষেত্রে তিনি যে সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন তার পরিণামে তিনি সাহিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন শ্রদ্ধা, সম্মান ও অবিস্মরণীয় অহংকার । পারদর্শিতা ও সিদ্ধহস্তের ছাপ রয়েছে তার ছোটগঙ্গে। ১৯৪৩ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত কালপরিসরে তার মাত্র সাতটি গল্পের সন্ধান মেলে। তার গল্পগুলাে হচ্ছে : ক. নগ্ন পা খ. ফিডিং বটল গ. বাবা ফেকু ঘ. ন্যাংটার দেশ ঙ. খড়ম চ, একটি তালাকের কাহিনী ছ, মানুষের জন্যে মুনীর চৌধুরীর গল্পের উপকরণগুলাের মধ্যে মিলন-বিরহ, অভাব-অনটন, পারিবারিক কলহ-যুদ্ধ, শ্রমজীবী মানুষের জীবনচিত্র, জীবনের দৈনন্দিনতা ও অন্তর্লোক, মানুষের জাগতিক ও মানসিক দ্বন্দ্ব-বৈচিত্র্য বিদ্যমান। শৈল্পিক দায়িত্ববােধ ও সৃষ্টিশীল সত্তা দিয়ে তিনি নির্মণ করেছেন তাঁর গল্পের স্বতঃস্ফুর্ত গতি। বিষয়বিন্যাস, চরিত্রায়ণ, দৃষ্টিকোন ও পরিচর্যা প্রভৃতি ছােটগাল্পিক শিল্পরীতির ক্ষেত্রে তাঁর সপ্রতিভ ও বিশ্ববিস্তারী চিন্তাচেতনা এক স্বকীয় মাত্রা সংযােজন করেছে যা বিশিষ্টতার পরিচয়বাহী। প্রকাশরীতির অভিনবত্ব, গল্পের আধুনিকতা ও শৈল্পিক শব্দপ্রতিমা তাঁর লেখনীসত্তাকে করেছে ব্যঞ্জনাময় ও সুদূরসঞ্চারী। গবেষক মােহাম্মদ জয়নুদ্দীন বলেন, “শিক্ষিত অশিক্ষিত জনমানুষ সম্বলিত সমাজব্যবস্থায় নরনারীর দ্বন্দ্ব-কলহ-মিলন,
আরোও পড়ুন –
রক্তাক্ত প্রান্তর নাটকের কাহিনী
ধর্মীয় কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত জনজীবন, বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুর্ভিক্ষের পীড়নে পিষ্ট মানুষের আকুল আকুতি ও নির্মম পরিণতি, উচ্চ শ্রেণী প্রতিনিধির দাপট ও কলুষিত মানুষিকতার স্বরূপ উদঘাটন, দেশজ বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের সূক্ষ্ম প্রয়ােগ মুনীর চৌধুরীর ছােটগল্পকে করেছে ঐশ্বর্যমণ্ডিত।” গল্পের বিষয়বস্তু নির্বাচনে মুনীর চৌধুরীর জীবনভঙ্গিতা, মনােদৃষ্টি ও আন্তরিকতা সুস্পষ্টভাবে বিচিত্র চিন্তাচেতনায় উম্মীলন ঘটেছে। রচনার বিষয় নির্বাচন ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে তার নিজস্বতা বিদ্যমান একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই। তাঁর রচনাশৈলী শিল্পসার্থকতার বৈদগ্ধ্যপূর্ণ, অলঙ্কারবহুল ও চেতনাপ্রবাহী। তাঁর গল্পের সূক্ষ্ম রসবােধ, জীবনভাবনা ও শিল্পাঙ্গিক দিক বিবেচনা করে তাকে বার্ণার্ড শ কিংবা শেখভ-এর সমকক্ষ বলা যায়।গবেষক মােহাম্মদ জয়নুদ্দীনের ভাষ্য, মুনীর চৌধুরীর শিল্পমানসে গল্পকার ম্যাক্সিম গাের্কীর চেয়েও বেশি নাড়া দিয়েছেন নাট্যকার হেনরিক ইবসেন এবং কথাকোবিদ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। সে-সঙ্গে সর্বদাই সক্রিয় ছিলাে লেখক মুনীর চৌধুরীর উদারমানবিক জীবনদৃষ্টি, স্বদেশভাবনা ও শিল্পপ্রজ্ঞা। সাহিত্যের সবচেয়ে শক্তিশালী ও অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে প্রবন্ধসাহিত্য। এই শাখায় মুনীর চৌধুরী বিপুল মননশীলতা ও ঐকান্তিক নিষ্ঠা নিয়ে বিচরণ করেছেন।
তাঁর সৃষ্টিশীল শিল্প অন্বেষা, অনুসন্ধিৎসা ও সূক্ষ্মবিশ্লেষণক্ষমতা তাঁর প্রবন্ধসাহিত্যকে করেছে আন্দোলিত ও সৃজনমুখর। তার লেখনীর ছোয়ায় বাংলা সাহিত্যে প্রবন্ধগুলি হয়ে উঠেছে চিরঞ্জীব ও মৃত্যুঞ্জয়ী। তার প্রবন্ধের বিষয়বস্তু সহজ-সরল-সজীব ও নিটোল এবং গবেষণামূলক। গতিশীল মননপ্রবাহের ক্ষেত্রে তাঁর প্রবন্ধ তাৎপর্যপূর্ণ গৌরবােজ্জ্বল মর্যাদায় অভিষিক্ত। প্রবন্ধ নির্মাণের প্রেরণা ও উদ্দীপনায় সচেতন শিল্পিমন মুনীর চৌধুরীকে সমাজ-মনীষার সার্থক সমালােচকে পরিণত করেছে। মানবিক মেধা,মননের পরিণতি অর্জনের ক্ষেত্রে প্রবন্ধের ভূমিকা অত্যন্ত অপরিসীম। এ প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক হাসান হাফিজুর রহমানের ভাষ্য : ” প্রবন্ধ-সাহিত্য মননচর্চার পরিণতির সঙ্গে জড়িত।বলা চলে, মননশীলতার বিকাশের উপর এ বহুলাংশে নির্ভরশীলও।
সমাজদেহে পরিণতির আভাস না এলে, অন্ত তঃপক্ষে পরিণতির জন্যে আর্তি দেখা না দিলে মননচর্চার স্ফূরণ খুব একটা গতি পায় না, বলবার কথা সমাজের ভেতরেই উদ্গত হয়। কবিতা গল্প উপন্যাসে যেসব কথার সবগুলাে বলে শেষ করাও যায় না। প্রবন্ধের শৈলী তখন আপন তাগিদে পথ কাটতে থাকে।” বাঙালি মুসলমান সমাজের মননচর্চায় জীবনাভঙ্গতার এক নতুন প্রান্ত উন্মােচিত হয়েছে মুনীর চৌধুরীর প্রবন্ধ সংকলনে। জাতির সাহিত্য-সংস্কৃতির বর্তমানতাকে বৈচিত্র্যসন্ধানী ও সমাজভিত্তিস্পর্শীরূপে গড়ে তুলেছেন তিনি তাঁর প্রবন্ধের মানদণ্ড বিচার-বিশ্লেষণে। ফলে সত্তাসন্ধান ও জাতিসত্তাসন্ধান তাঁর প্রবন্ধে প্রাসঙ্গিকতা রূপ লাভ করেছে। গবেষক-সমালােচকের মূল্যায়নপ্রবণ দৃষ্টিভঙ্গির মিথস্ক্রিয়ায় মুনীর চৌধুরীর প্রবন্ধ বিবেচনার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা সংযােজন করে সচেতন প্রবন্ধশিল্পীর আসনে অভিষিক্ত হয়েছেন-যা তাঁর জীবনবােধ ও শিল্পদৃষ্টির পরিণত অভিব্যক্তির ইঙ্গিতবহ। মুনীর চৌধুরীর নাটকবিষয়ক প্রবন্ধগুলিকে বাদ দিলে তার বিশেষ উল্লেখযােগ্য প্রবন্ধগুলির মধ্যে আসুন-চুরি করি, আধুনিক উর্দু কবিতা, সতেরাে শতাব্দীর ‘হেয়কেয়ি’ কবিতা, কামাল চৌধুরীর কবিতা, কেন লিখিনি ও চোর অন্যতম। গবেষক মােহাম্মদ জয়নুদ্দিন বলেন,” এ-সব প্রবন্ধে মুনীর চৌধুরীর বিষয়-জ্ঞানের গভীরতা, সমালােচকের নিরপেক্ষতা, তির্যক ও সূক্ষ্ম রসবােধ, বুদ্ধি ও যুক্তির সম্বম্বিত প্রকাশ এবং ভাষা ও রচনাশৈলীর অদ্ভুত সার্থকতা লক্ষ্য করা যায়।” মুনীর চৌধুরী একজন প্রথিতযশা ও বিচক্ষণ প্রাবন্ধিক। আধুনিক শিল
সংলাপ নির্মাণকৌশলে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর শৈল্পিক সংহতি ও পরিমিতবােধ সুস্পষ্ট। তার পাণ্ডিত্যের ওজস্বিতায় গদ্যশৈলী হয়ে ওঠেছে কাব্যময় ও ব্যঞ্জনাময়। ভাষায় সাহিত্যিক রূপায়ণে তিনি যুগপৎ নিরাসক্ত ও শিল্পসচেতন কখনও কোনও বিশিষ্ট পদের অকৃত্রিম আঞ্চলিকতা অটুট রেখেও সমগ্র বাক্যটি গঠন করেছেন পরিমার্জিত সাহিত্যিক গদ্যরীতির আদলে। এই প্রবণতার চূড়ান্ত প্রকাশ বহিপীরের মুখ্য চরিত্রের মুখের ভাষায়, “আপনি লক্ষ্য করিয়া থাকিবেন যে, আমি কথাবার্তা বিলকুল বহির ভাষাতেই করিয়া থাকি। ইহার একটি হেতু আছে। দেশের নানা স্থানে আমার মুরিদান । একেক স্থানে একক ঢঙ্গের জবান চালু। এক স্থানের জবান অন্য স্থানে বােধগম্য হয় না, হইলেও হাস্যকর ঠেকে। আমি আর কি করি। আমাকে উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সব দিকেইযাইতে হয়, আমি আর কত ভাষা বলিতে পারি। সে সমস্যার সমাধান করিবার জন্যই আমি বহির ভাষা রপ্ত করিয়া সে ভাষাতেই আলাপ-আলােচনা কথাবার্তা করিয়া থাকি। বহির ভাষাই আমার একমাত্র জবান। তাছাড়া কথ্য ভাষা আমার কানে কটু ঠেকে। মনে হয় তাহাতে পবিত্রতা নাই, গাম্ভীর্য নাই।
আমার কর্তব্য মানুষের কাছে খােদার বাণী পৌছাইয়া দেওয়া। উক্ত কার্যের জন্য পুস্তকের ভাষার মত পবিত্র ও গম্ভীর আর কোনাে ভাষা নাই । কথ্য ভাষা হইল মাঠ-ঘাটের ভাষা, খােদার বাণী বহন করার উপযুক্ততা তাহার নাই।” মুনীর চৌধুরী সাহিত্যসমালােচক হিসেবে যেমন সমাদৃত, তেমনি চিত্রশিল্পী হিসেবে সূক্ষ্ম দৃষ্টিসম্পন্ন ও সফল। তার প্রমাণ মিলবে ‘শিল্পী কামরুল হাসান’ শিরােনামযুক্ত প্রবন্ধে। আর্টস কাউন্সিলের উদ্যোগে আয়ােজিত কামরুল হাসানের একটি চিত্র প্রদর্শনী দেখে তিনি এ-প্রবন্ধটি লেখেন। কামরুল হাসানের প্রাগ্রসর চিন্তা ও চেতনা তার শিল্পীমানসে প্রভাসঞ্চারী ভূমিকা রেখেছে। তিনি ছিলেন মুক্ত হৃদয়ের মানুষ। বাস্তবপরিবেশের চিত্র তিনি এঁকেছেন অত্যন্ত সততার সঙ্গে। প্রকৃতি ও সমাজের বিচিত্র দৃশ্য ও ঘটনাকে তিনি পরিমার্জিত, ঐশ্বর্যমণ্ডিত ও ব্যঞ্জনাধর্মী রূপে অঙ্কন করেছেন তার শিল্পীমনের রংতুলি দিয়ে যা বিদগ্ধ সমাজে প্রশংসিত ও যথাযােগ্য মর্যাদার শিল্পস্বাক্ষর। বাঙালি জাতির অস্তিত্ব বিকাশের ইতিহাসে তার নান্দনিক সৃষ্টির সক্ষমতায় জীবন-অভীপ্স আত্মজিজ্ঞাসা ও অস্তিত্বচেতনার স্বরূপসত্য প্রকাশ পেয়েছে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের প্রিয় শিষ্য ছিলেন কামরুল হাসান। গুরুর মতেই শিষ্যও ছিলেন সমুন্নত দেহ, সবল স্বাস্থ্যের অধিকারী, স্বদেশভক্ত, মৃত্তিকামুগ্ধ ও নতুনতর বৈচিত্র্যের সংবাদবাহী। শিল্পী কামরুল হাসান সম্পর্কে মুনীর চৌধুরীর ভাষ্য,
“অত্যাধুনিকদের অঙ্গ ভঙ্গে তিনি উত্তেজিত হননি, রুষ্ট তরুণের প্রতিবাদের মধ্যে আতংকিত হবার মত কিছুই খুঁজেই পাননি। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অক্লান্ত কামরুল হাসান নিজেও রঙরূপ ও মাধ্যমের কোন সুনির্দিষ্ট একক এলাকায় নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। অবশ্য নিছক খেয়ালীপনার দাস তিনি কোনােদিনই ছিলেন না। সাম্প্রতিক চিত্রকলার রূপ বিভ্রাটের কেন্দ্রস্থলে বাস করেও তিনি স্থিরচিত্ত ও আত্মবিশ্বাসী। বস্তুর অবয়ব সংস্কারের শৃঙ্খলাকে তিনিও ভেঙ্গেছেন, কিন্তু ভেঙ্গে একেবারে তছনছ করে ফেলেন নি, তাকে পুনর্গঠিত করেছেন, নবপরিচর্যা দান করেছেন। প্রদর্শিত ছবিতে এই সুষমার ছাপ ষােল আনা বিদ্যমান ছিল। — রং এর নির্বাচনে ও ব্যবহারে, রেখার বিশিষ্ট সরলায়ন ও নকসীকরণে কামরুল হাসান সজ্ঞানে বাংলার লােকজীবনের সমৃদ্ধি বর্ধনকারী কামার-কুমার পটুয়ার কারু কল্প থেকে অবাধে ঋণ গ্রহণ করেছেন।
তাই বলে কামরুল হাসান লােকশিল্পী নন, তিনি আধুনিক চিত্রকর, কুশলী এবং বিদয়, আত্মসচেতন এবং সমাজসচেতন।” মুনীর চৌধুরী গ্রন্থসমালােচনার ক্ষেত্রে ছিলেন নিরপেক্ষ ও শিল্পোত্তীর্ণ । তাঁর গ্রন্থ সমালােচনায় বাস্তবদৃষ্টি ও প্রগতিবােধের পথনির্দেশনার সন্ধান পাওয়া যায়। তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে রুচি ও বৈদগ্ধ্য পরিচর্যার আঙ্গিকে বহু-সংখ্যক সমকালীন গ্রন্থের সমালােচনা লিখেছেন যাতে প্রগতিচেতনার স্পন্দন সুস্পষ্ট। যে সব লেখক ও গ্রন্থের তালিকা তিনি প্রণয়ন করেছেন, তাদের মধ্যে মােট পনেরজন সাহিত্যিকের আঠারটি গ্রন্থের আলােচনা স্থান পেয়েছে। এসব গ্রন্থসমালােচনাগুলি মুনীর চৌধুরী রচনাবলী,চতুর্থ খণ্ডে সংকলিত হয়েছে। লেখকের নাম ও গ্রন্থের তালিকাগুলাে নিম্নে দেওয়া হলাে : আবুল ফজল : রেখাচিত্র শহীদুল্লাহ কায়সার : রাজবন্দীর রােজনামচা আহসান হবীব : সারা দুপুর সানাউল হক : বন্দর থেকে বন্দরে রনেশ দাসগুপ্ত :
শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নে মােহাম্মদ : নজরুল ইসলাম ও আধুনিক বাংলা কবিতা মাহফুজউল্লাহ মােহাম্মদ মাের্তজা : প্রেম ও বিবাহের সম্পর্ক, জনসংখ্যা ও সম্পদ,চরিত্রহানির অধিকার নূরুল ইসলাম খান : মেহের জুলেখা হুমায়ুন কাদির : ডনর্জন মেঘ আবদুর রহমান : খােলা মন হামেদ আহমদ : প্রবাহ দিল আরা হাশেম : ঘর-মন-জানালা হাবীবুর রহমান : পুতুলের মিউজিয়াম বায়াজীদ খান পন্নী : বাঘ-বন-বন্দুক মযহারুল ইসলাম : পাগলা কানাই মুনীর চৌধুরীর গ্রন্থসমালােচনার পরিধি কলেবরে সংক্ষিপ্ত হলেও বাংলার ভাবজগৎ ও শিল্পসাধনায় এর পূর্ণাঙ্গ প্রাপ্তি সঞ্চারিত হয়েছে নতুনমাত্রায়। মানবিক মূল্যবােধ,সাহিত্য রসােপলদ্ধি ও বাঙালির চিন্তামননের ক্ষেত্রে মুনীর চৌধুরীর লেখনীর ছাপ নান্দনিক সমালােচনার পাশাপাশি ঋজুপ্রতিবাদের জয়গানে মূহ্যমান। অধিকাংশ গ্রন্থসমালােচনার ক্ষেত্রে গ্রন্থ-পরিচিতি, লেখকমানস, মূলবিষয়বস্তু ও প্রাসঙ্গিক যুক্তিনিষ্ঠ বিবরণ প্রদানে তিনি ছিলেন তীক্ষ্ম শাণিত ও তেজোদীপ্ত প্রখর ব্যক্তিত্ব। গবেষক মযহারুল ইসলামের গবেষণাগ্রন্থ কবি পাগলা কানাই-এর সমালােচনা করতে গিয়ে মুনীর চৌধুরী বলেন, ” পাগলা কানাই সম্পর্কে যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল হওয়া সত্ত্বেও গ্রন্থলেখক যে সকল দৃষ্টিকোণ থেকে স্তবস্তুতি নিবেদন করতে চান, তার সারবত্তা স্বীকারে অক্ষম। পাগলা কানাই ভাব-সাধক গ্রাম্য কবি, অশিক্ষিত কবি। এসকল কথা লেখক নিজেই বলেছেন। স্বীকারও করেছেন যে, “রবীন্দ্রনাথের সাথে পাগলা কানাইয়ের তুলনা একেবারে বাতুলতা।” কিন্তু এজন্যে ড. ইসলামের যে সংকীর্ণ ও মারাত্মক ক্ষোভ তা তিনি প্রচ্ছন্ন রাখেন নি।
বাংলা ভাষার কথা” মুনীর চৌধুরীর ভাষাবিষয়ক শিল্পসফল দক্ষতার পরিচয় বহন করে নিঃসন্দেহে। মুনীর চৌধুরী রচনাবলী তৃতীয়খণ্ডে তাঁর নিপুণ পরিকল্পনায় যে প্রবন্ধগুলি স্থান লাভ করেছে, সেগুলি হচ্ছে : মাতৃভাষা সরলীকরণ, বানান-সংস্কার’, ‘বর্ণমালা সংস্কার’, ‘উয় অনুস্বার এবং অন্তঃস্থব’, ‘বাঙলা মুদ্রলেখ্য’, জিকির’, ‘সাহিত্য, সংখ্যাতত্ত্ব ও ভাষাতত্ত্ব’, ‘বাংলা নাসিক্যধ্বণি ও নাসিক্যভবন এবং পূর্ববঙ্গ সরকারি ভাষা কমিটির সােপারেশ প্রসঙ্গে। মাতৃভাষা’ প্রবন্ধে মাতৃভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে মুনীর চৌধুরী বলেন, “মাতৃভাষা সমাসবদ্ধ পদ। ব্যাকরণের নির্দেশ অনুযায়ী ষষ্ঠী তৎপুরুষ । অভিধানে অর্থ লেখা আছে স্বদেশের ভাষা। কিন্তু অভিধানের অর্থে সকলের চিত্ত সন্তুষ্ট হয় না। হওয়ার কথাও নয়। ভাষার স্বাভাবই হল অস্পষ্ট থাকা, অন্তরাল সৃষ্টি করা, হরবােলার কৌতুকে মেতে ওঠা । ভাষা খেলা করে জিবের ডগায়, ঘােষিত হয় গলার মধ্য দিয়ে প্রাণ লাভ করে ফুসফুস থেকে। এও বাইরের সত্য। আসলে ওর জন্ম বুকের মধ্যে, উৎস মানুষের মন।” সরলীকরণ বানান-সংস্কার’, বর্ণমালা-সংস্কার ও জিকির প্রমুখ প্রবন্ধ বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করেছেন যে, ভাষা তার নিজস্ব গতিতে চলে এটা পরিবর্তনশীল নয়। তবে এর পরিবর্তন ঘটে দীর্ঘ প্রক্রিয়া ও সৃজনশীল প্রতিভাবান সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে। বাংলা ভাষার কথা’ শিরােনাম যুক্ত অধ্যায়ের প্রবন্ধসমূহে মুনীর চৌধুরীর অন্তলীন শিল্পনৈপূণ্যের পরিচয়ে বিচিত্র চিন্তা-চেতনার উন্মীলন ঘটেছে যা ভাষা ও ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে তাঁর পাণ্ডিত্যের ছাপ সুস্পষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচ্য। বাংলা ভাষা-বর্ণনার ভূমিকা শীর্ষক একটি মনােজ্ঞ ভাষাতাত্ত্বিক আলােচনার স্থান করে দিয়েছেন মুনীর চৌধুরী এই প্রবন্ধে। ভাষা এবং ভাষাতত্ত্ব সম্পর্কে তার মতামত হচ্ছে,
“ভাষা মানুষের মুখের জিনিস, সামাজিক জীবনে যে সকল বিচিত্র আচরণের মধ্যে সে নিজেকে ব্যাপৃত রাখে ভাষা তারই একটা বিশিষ্ট প্রকাশ। চলাফেরার মতােই ভাষা একটি মানবিক আচরণ যা সম্পূর্ণরূপে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং সেই পরিমাণে সাক্ষাৎ পর্যবেক্ষণ এবং বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের অধীন। ভাষার যে তাৎপর্য ইন্দ্রিয়াতীত আমাদের সীমিত আলােচনায় তা অগ্রাহ্য। অপরপক্ষে, ভাষাতত্ত্ব একান্তভাবে ভাষাবিজ্ঞানীর ভাষা। ভাষাকে বর্ণনা করার একটা কৌশল মাত্র। ভাষাবিজ্ঞানীর নিজের প্রয়োজনে নির্মিত এ এমন একটি হাতিয়ার যাকে আশ্রয় করে তিনি ভাষা সম্পর্কে তাঁর ইন্দ্রিয়লদ্ধ ধ্যান-ধারণাকে নিপূণভাবে ব্যক্ত করতে পারেন। অন্যান্য বিজ্ঞানবিদ্যার সঙ্গে ভাষাবিজ্ঞানের এই একটা প্রধান পার্থক্য। বর্ণিত বিষয় ও বর্ণনার মাধ্যম দুইই এখানে এক অর্থাৎ ভাষা। উভয়ের মধ্যে এই অপরিহার্য ঐক্য তত্ত্বের দিক থেকে কিছু অহেতুক জটিলতার সৃষ্টি করেছে।” প্রকৃতপক্ষে মুনীর চৌধুরী ছিলেন একজন বিচক্ষণ ভাষাতত্ত্ববিদ। ভাষাতাত্ত্বিকমূল্যায়নে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের বিশ্লেষণপদ্ধতি, বাকধ্বনির বর্ণনা, Phoneme বিচার, রূপতত্ত্ব ও বাক্যরীতি আলােচনায় তিনি ছিলেন একজন গবেষক- নির্ভরযােগ্য গবেষক। উক্ত প্রবন্ধের আলােচনায় তিনি বিজ্ঞানসম্মত ভাষাতাত্ত্বিক মূল্যায়ন করেছেন গভীর প্রজ্ঞা ও সূক্ষ্ম রসবােধ দিয়ে, “যে শাস্ত্র সকল রকম সম্ভাব্য বিচিত্র বাধ্বনির বর্ণনায় উদ্যোগী তাকেই ইংরেজীতে Phonetics বলে। আমরা বাংলায় তাকে ধ্বনিতত্ত্ব বলে থাকি। ধ্বনিরূপ তত্ত্ব বললে হয়ত আরাে ভালাে হয়, কারণ ধ্বনির ভাষাগত তাৎপর্য নয় কেবলমাত্র শ্রবণগ্রাহাজপের শারীরিক বর্ণনাই হােলাে এই শাস্ত্রের লক্ষ্য। দুটো ধ্বনির মধ্যে অতি সামান্য পার্থক্য যদি কোন বিশেষ ভাষায় অর্থগত কোন তাৎপর্য বহন নাও করে, ধ্বনিরূপের তত্ত্বালােচনায় সে তুচ্ছ পার্থক্যকেও প্রকট করে তুলতে হবে।
এরকম দুরূহ বর্ণনায় প্রয়াসী হওয়ার সার্থকতা এইখানে যে এতে করে ও স্বকর্নে শোনার মতাটা আর নিতান্তই অনুমান বা অভ্যাসের দাস হয়ে থাকে না। কাৰে । কানের পর্দাটা সরকারী ঘােষকের ঢােলের পরিবর্তে ওস্তাদ বাজিয়ের তলায় পরিণতি করে। ধ্বনির সূক্ষ্মতম তারতম্যও তখন জাজ্বল্যমানরূপে অনুভূত হয়। বাকধ্বনির অন্তহীন রূপগত বৈচিত্র্য সম্পর্কে যখন এরকম সুস্পষ্ট এবং সম্পূর্ণ ধারণা জন্মে তখনই বিশেষ ভাষায় গ্রাহাবিশিষ্ট বাকধ্বনিসমূহের ভাষাগত সত্তার, তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা সহজ হয়।” এক কথায়, ভাষার উৎকর্ষসাধনে তিনি ছিলেন বিচিত্র নবমাত্রিক ব্যঞ্জনায় যথাযোগ্য মর্যাদার শিল্পোত্তীর্ণ ব্যক্তিত্ব। মুনীর চৌধুরী একজন সৃজনী প্রতিভাগুণে সাহিত্যাঙ্গন নন্দিত গবেষক হিসেবে সমাদৃত। লেখকমানস ও লেখার শিল্পমূল্য বিচারে তিনি অদ্বিতীয় এবং আন্তর্জাতিক শিল্পচেতনায় উদ্বুদ্ধ। মীর-মানসের সাহিত্য আলােচনায় বিষাদ-সিন্ধুর পুনবিচার’, উদাসীন পথিকের মনের কথা’, ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ বাংলা আত্মজীবনী ও মীর মশাররফ হােসেন’ এবং ‘বিবি কুলসুম’ উল্লেখযােগ্যভাবে মুনীর চৌধুরীর নিপুণ কলমের খোঁচায় লেখনীর ছন্দ ছোঁয়ায় যথাযােগ্য মর্যাদায় শিল্পসত্ত্বার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছে।
মীর মানসের জন্য তিনি দাউদপুরস্কার লাভ করেন। মীর মশাররফকে নতুনভাবে জানার জন্য এবং নতুন আঙ্গিকে ও ভিন্নমাত্রায় তাঁকে মূল্যায়ন করার জন্য বিষাদ-সিন্ধুর চরিত্র বিশ্লেষণে মুনীর চৌধুরীর আধুনিক ছাপ সুস্পষ্টভাবে আকাশের ধ্রুবতারার মতে জ্বলজ্বলে। অশ্রুময় ও রক্তঝরা আলেখ্যনির্মাণে মুনীর চৌধুরী নিজেকে বিচক্ষণ ও বস্তুবাদী পর্যবেক্ষক হিসেবে বিষাদ সিন্ধুর পুনর্বিচারে বিচার করবার প্রয়াস পেয়েছেন এভাবে : এক, গ্রন্থের সর্বাপেক্ষা স্পষ্ট এবং প্রদীপ্ত চরিত্র এজিদের। তার চিন্তায়-আচরণে, আবেগে-অভিব্যক্তিতে এমন একটা দৃঢ় গাঢ় ঔজ্জ্বল্য আছে যে, অন্যান্য চরিত্র তার পাশে নিতান্ত মর্যাদাহীন বলে মনে হয়। নীতিবিদের সৃষ্টিতে এজিদের ক্রিয়াকর্ম যত গর্হিত ও অভিশপ্ত বিবেচিত হােক না কেন, চরিত্র বিচারের সাহিত্যিক মানদণ্ডে এজিদের মতাে প্রাণময় পূর্ণাবয়ব পুরুষ সমগ্র উপন্যাসে দ্বিতীয়টি নেই। এজিদ পাপী, ধর্মদ্রোহী এবং ইন্দ্রিয়পরবশ। কিন্তু এজিদের পাপের প্রকৃতি অসামান্য, তার বিকাশ প্রলব
জনপ্রিয় সার্চঃ মুনীর চৌধুরী, মুনীর চৌধুরীর সাহিত্য জীবন, মুনীর চৌধুরীর সাহিত্য অবদান, মুনীর চৌধুরীর ছোটগল্প, সাহিত্য সমালোচক মুনীর চৌধুরী, গ্রন্থ সমালোচক