লোকসংগীত কি? লোকসংগীত কাকে বলে বিস্তারিত
লোকসঙ্গীত কী?
সাধারণত লোক মুখে মুখে রচিত ও প্রচলিত সঙ্গীতই লোকসঙ্গীত। লোকজীবনকে | আশ্রয় করে এই সঙ্গীত রচিত বলে এতে অখণ্ড মানুষের পরিচয় পাওয়া যায়। উৎসবমুখর বারো মাসে তের-পার্বণের দেশ এই দেশে বিচিত্রমুখী লোকসঙ্গীতের গীতিময়তা চোখে পড়ে। লোকসাহিত্যের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও জনপ্রিয় শাখা হচ্ছে এই লোকসঙ্গীত। সুদীর্ঘকাল ধরে লোকের মুখে মুখে প্রচলিত এবং সমাজে নিজস্ব বলে স্বীকৃত গানগুলোকে লোকসঙ্গীত নামে আখ্যায়িত করা হয়। ১৩৪ আদিমকালে মানুষের জীবন চর্যায় সুরই ছিল একমাত্র প্রকাশ মাধ্যম। এর অনেক পরে এসেছে ভাষার ব্যবহার ।
মানুষের সহজাত কৌতূহল ও অনুকরণ প্রবণতার কারণে সে নদী নির্ঝরের সুমিষ্ট শব্দ, পাখির কলকাকলি এবং সমুদ্রের গুরুগম্ভীর আওয়াজ, বাতাসের নিক্বণ ধ্বনি ইত্যাদিকে ধারণ করেছে আপন কন্ঠে, আত্মস্থ করেছে তাদের ধ্বনি বৈশিষ্ট্য ও ধ্বনি মাধুর্য। এভাবেই সঙ্গীতের প্রথম সূত্রপাত। আদিমকালে আকাল, ব্যাধি, মহামারি, পরাক্রমশালী শত্রু, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ইত্যাদি থেকে কল্পনায় সৃষ্টি হয় ভৌতিক, অদৃশ্য আত্মা ও ঐন্দ্রজালিক নানা শক্তির প্রতি বিশ্বাস ও ভয়। অদৃশ্য রক্ষার প্রচেষ্টায় মানুষকে শক্তি ও আত্মাকে স্তব-স্তুতির মাধ্যমে তুষ্ট করে জীবনকে আকর্ষনীয় করে অন্তরের আকুতি নিবেদন করার মাধ্যমে সৃষ্ট ও প্রসারিত হয়েছে লোকসঙ্গীত। লোকসাহিত্যের অন্যান্য
উপাদানগুলো অপেক্ষা লোকসঙ্গীতের বাণী ও সুরের পরিবর্তনশীলতা তীব্র ও দ্রুতগতির। লোকসঙ্গীতের লিখিত উপাদান স্থায়ীভাবে রক্ষা পেলেও সুরের স্থায়িত্ব থাকে না। গায়ক, ও গায়িকার নির্বাহিত সুরের বদল হয় আস্সার। লোকসঙ্গীত আবার অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে অন্বিত বলে পরবর্তীকালে নৃত্য-ক্রিয়ার সঙ্গেও সমন্বিত হয়। কার্যত লোকসঙ্গীতকে বাণী, সুর নৃত্য ও বাদ্যের সহযোগ বলা চলে।
লোকসঙ্গীতের সংজ্ঞা
লোকসঙ্গীতের সংজ্ঞা গ্রামবাংলার সমাজ জীবনে যে গান বা সঙ্গীত মুখে মুখে রচিত হয়ে মুখেই প্রচার লাভ করে তাকেই সাধারণত লোকসঙ্গীত বলা হয়। ১৩০০ সংহত গোষ্ঠীগত লোকসমাজের রসচেতনা ও শিল্পবোধের স্বতঃস্ফূর্ত সুর ও বাণী নির্মিতির অন্যতম লৌকিক উপাদান লোকসঙ্গীত। লোকসাহিত্যের অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয়, ব্যাগক প্রচারিত, সহজ সরল ভাবরসের সাবলীল প্রকাশ, শ্রুতি-স্মৃতিনির্ভর মৌখিক রচনা লোকসঙ্গীত । লোকসঙ্গীতের সংজ্ঞা দেয়া কঠিন। ভাব, চিত্র, কাহিনী অবলম্বনে ছন্দময় সুরাশ্রিত রচনাকে লোকসঙ্গীত বলা যায়।
জর্জর হারজা বলেন, “Folksongs are best defined as song which are current in the repertory of a folk-group.” অন্য একটি সংজ্ঞায় বলা হয়েছে,it is oral circulation that is the best general criterion of what is a folk song. সংজ্ঞাগুলো স্পষ্ট ও অর্থবাহী নয়। লোকসমাজে পুরুষানুক্রমে প্রচলিত ও সুর সংযোগে প্রচারিত রচনাকেই লোকসঙ্গীত বলা হয়েছে।
কে. এইচ. ব্রুকভ্যান্ড বলেন, The folksong is song with melody, which originated anonymously among unlettered folk in time past and which remained in currency for a considerable time as a rule for centuries. ইংরেজি প্রতিশব্দ Folk songs. সাধারণভাবে ‘সুদীর্ঘকাল যাবৎ’ লোকের মুখে মুখে প্রচলিত এবং সমাজে নিজস্ব বলে স্বীকৃত গানগুলোকে লোকসঙ্গীত বলে।
এই লোকসঙ্গীত রচনার সময় কিংবা স্রষ্টা সম্পর্কে যে নিশ্চিতভাবে কোনো তথ্য জানা যায় না, তার কারণ ব্যক্তি বিশেষের দ্বারা বিশেষ কোনো সঙ্গীত রচিত হলেও তিনি সেই সঙ্গীত রচনা করেন সংহত সমাজের মুখপত্র রূপে। আর রচিত সংগীতে ব্যক্তি বিশেষের হৃদয়ানুভূতিটুকুই শুধু বিধৃত হয় না, সমগ্র সমাজের অভিজ্ঞতাটুকুও প্রতিফলিত হয়।নতুবা তা সমগ্র সমাজের যৌথ সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে না। অনেক সময় একাধিক ব্যক্তি ও লোকসঙ্গীত রচনায় অংশগ্রহণ করেন।
আরোও পড়ুনঃ লোক সংস্কৃতি কি? কাকে বলে সহজে জেনে নিন ।
লোকসঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য
বাংলা লোকসঙ্গীতের রূপ ও বিষয়গত বৈচিত্র্য তার এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। বাঙালির জাতীয় চরিত্র, যেমন, তার সঙ্গীত তেমনি প্রধানত দেশের প্রত্যক্ষ প্রকৃতিকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে। নদীর প্রভাব তার জীবনে যেমন গানেও তেমনি উজ্জ্বল। তথাপি সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী মানুষের এলাকাগত পরিবেশ এক নয় বলে লোকসঙ্গীতে আঞ্চলিক প্রভাব সুস্পষ্ট। পশ্চিম সীমান্ত বাংলার লোকসঙ্গীতের মৌলিক ভিত্তি ঝুমুর, উত্তর বাংলার ভাওয়াইয়া, পূর্ববাংলার ভাটিয়ালি, দক্ষিণ বাংলার সারি আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্যে নির্ভরশীল। এছাড়া সাঁওতাল, শবর, লোধা, হাজং, মোরং, চাকমা প্রভৃতি উপজাতির সঙ্গীতও আপনি বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। এই আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যে থাকলেও সমগ্র বাঙালি জাতি লোকঙ্গীতের দিক থেকে একটি অখণ্ড ঐক্য সূত্রে গ্রথিত ।
দ্বিতীয়ত, লোকসঙ্গীত, আধুনিক যে কোনো সঙ্গীতের মতোই বাণী, ও সুরের সমন্বিত রূপ। তবে এ সঙ্গীতের বাণীর ভাষা আঞ্চলিকতায় পরিপূর্ণ এবং সুরও আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
তৃতীয়ত, লোকসঙ্গীত সাধারণত একটি মাত্র ভাব বা বিষয়কে অবলম্বন করে গড়ে ওঠে।
চতুর্থত, লোকসঙ্গীত নিরক্ষর লোকসমাজে লালিত হয় এবং নিরক্ষর রচয়িতা ও গায়ক গায়িকাই লোকসঙ্গীতের ঐতিহ্যকে পুরুষানুক্রমে সামনের দিকে নিয়ে যায় ।
পঞ্চমত, লোকসঙ্গীতের একটি প্রধানতম উপাদান তার সুর। সুরের বৈচিত্র্য, সঙ্গীতের চরিত্র ও কাঠামো, জেনর, ঠাট, লয়, তাল ইত্যাদি অনুধাবনের পথ হলো সংগীতিক বিশ্লেষণ। স্বরের রূপভেদ, ছন্দে, ধ্বনিতে ও বাচনভঙ্গিতে, আঞ্চলিকতার বৈশিষ্ট্য মূর্ত হয়ে ওঠে।
ষষ্ঠত, লোকসঙ্গীতের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য আঞ্চলিকতার ছাপ বা চিহ্ন। লোকসঙ্গীতের কথা বা বাণীর ভাষা সর্বদাই আঞ্চলিক উপভাষা।
লোকসঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতামত উদ্ধৃত হলো- >. Folk song is a music that has been submitted to the process of oral transmissing, it is a product of evolution and is dependent on the circumstancs of continutiy, variation and selection. ১৪০ 2. Folk song are created by individuals or groups, but generally without the identity of the authors, and are the products of a ১৪১ society of region.” ৩. লোক-সঙ্গীতের প্রধান বিশেষত্ব এই যে, ইহা মৌখিক রচিত হইয়া মৌখিক প্রচার লাভ করে, সমাজের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার করিলেও কোনোদিনই ইহার লিখিয়া রাখিবার সংস্কার গড়িয়া উঠে না।…প্রবহমানতার মধ্য দিয়াই লোক- সঙ্গীতের প্রাণশক্তি রক্ষা পায়।