ব্রত কথা কি
ব্রতকথা কি ব্রতকথাগুলো বাংলা লোককথার একটি বিশিষ্ট অঙ্গ। এই বিভাগটি ভারতীয় ঐতিহ্যের নিজস্ব সৃষ্টি। বিশেষ করে বললে বাঙালির নিজস্ব সাংস্কৃতিক সম্পদ। বাংলা ব্রতকথায় যে আচার অনুষ্ঠানের উল্লেখ রয়েছে তার নিদর্শন পৃথিবীর বহু লোকসমাজ ও আদিম জনজাতির মতো আনুষঙ্গিক এমন কাহিনী বিন্যাস আর কোথাও পাওয়া যায়নি। বাঙালির একান্ত ও নিজস্ব ঐহিক ধর্মবোধ যে ব্রতকথার আচার অনুষ্ঠানের উল্লেখ রয়েছে তার নিদর্শন পৃথিবীর বহু লোকসমাজ ও আদিম জনজাতির মধ্যেই পাওয়া যাবে;
কিন্তু বাংলা ব্রতকথার মতো আনুষঙ্গিক এমন কাহিনী বিন্যাস আর কোথাও পাওয়া যায়নি। বাঙালির একান্ত ও নিজস্ব ঐহিক ধর্মবোধ থেকে ব্রতকথার আচার- অনুষ্ঠানের জন্ম, আর তাকে ঘিরেই সরস অথচ মরমী কাহিনীর উৎসার ঘটেছে। ব্রতের মধ্যে বাঙালি নারী পারত্রিক কল্যাণ চাননি, অদেখা সুদূরের স্বর্গবাস আকাঙ্ক্ষা করেননি, তিনি চেয়েছেন অভাবহীন সংসার, স্বামী-পুত্রের অক্ষয় আয়ু, এয়োতির অক্ষয় সিঁথির সিঁদুররেখা, গাঁয়ের মঙ্গল এবং সর্বোপরি ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’। ব্রতগুলোর উৎসকাল সম্পর্কে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন যে, দুই থাকে বিভক্ত এই মেয়েলি ব্রত আর অনুষ্ঠানগুলো খুঁটিয়ে দেখলে পুরাণেরও পূর্বেকার বলে বোধহয় এবং যার মধ্যে হিন্দু-ধর্ম এবং হিন্দুপূর্ব এই দুই ধর্মের একটা আদান-প্রদানের ইতিহাস রয়েছে। ব্রতের কাহিনীতে কতকগুলো বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়।
আরোও দেখুনঃ লোক সংস্কৃতি কি ? লোক সংস্কৃতি কাকে বলে ও বিস্তারিত
কাহিনীতেও দুই ধরনের দেবতা রয়েছেন, শান্তশিষ্ট ‘ভালো মানুষ’ দেবতা ও রুষ্ট দেবতা যিনি অবহেলা সহ্য করতে পারে না, কিন্তু প্রসন্ন হলে মানুষের উপকার করেন। মানুষের অবিকল প্রতিরূপ এসব দেবতারা। মানুষ ও দেবতা প্রায় একীভূত হয়ে রয়েছেন এখানে। দুধরনের ব্রত রয়েছে : শাস্ত্রীয় ও মেয়েলি। শাস্ত্রীয় ব্ৰত: এই ব্রতগুলোতে দেবতার কথা আছে, কিন্তু তারা শাস্ত্রীয় দেবতা নন, লৌকিক দেবতা। শাস্ত্রীয় দেবতার নাম কোনো কোনো ব্রতে থাকলেও তাদের আচার-আচরণ শাস্ত্রসম্মত নয়, পুরোপুরি লৌকিক । হিন্দু পুরাণের দেব-দেবীর কোনো মাহাত্ম্যকীর্তন এর মধ্যে করা হয়নি।
ব্রত অনুষ্ঠানের কাহিনীগুলোর ঐতিহাসিক সাহিত্যিক এবং সামাজিক মূল্য অপরিসীম। ব্রতের কাহিনীতে গ্রাম্য মেয়েরা সহজ ভাষায় নিজেদের মনের ভাব ব্যক্ত করে থাকে। তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, দৈনন্দিন জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত প্রভৃতি কাহিনীগুলোতে প্রকাশিত হয়। কাহিনীর দেব- দেবীর চরিত্রগুলো মানুষের মতো দোষ-ত্রুটিপূর্ণ এবং অনেক সময় তারা তাদেরই ভাগ্যের প্রতীক বলে মনে করে। আমাদের দেশে প্রচলিত ব্রতের নির্দিষ্ট সংখ্যা নিরূপণ করা কঠিন। ঋতুভেদে ব্রতাচারের বিভিন্নতা যেমন আছে আবার দেবতাদের প্রকৃতি অনুসারেও আলাদা আলাদা ব্রতের প্রচলন আছে। কিছু কিছু ব্ৰত গড়ে উঠেছে সামাজিক ও পারিবারিক কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন বস্তুকে কেন্দ্র করে।
বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ে প্রচলিত ব্রতগুলো নিম্নোক্তভাবে ভাগ করা যায়-
(১) প্রজনন, যাদুশক্তি, উর্বরা বৃদ্ধি এবং কৃষিবিষয়ক; পুণ্যিপুকুর, শিবপূজা, চম্পাচন্দন, পৃথিবী, গোকাল, অশ্বত্থ বট, গুপ্তধন, ধানগোছান, তেজোপর্ণ থোয়াথুয়ি, রণে-এয়ো, দশ পুতুল, ক্ষেত্র, বসুধারা, ভাদুরি, ইতুল লক্ষ্মী, যমপুকুর, তুষলী, তারণ, মাঘমণ্ডল, ইতুকুমার, বসন্তরায়, উত্তম ঠাকুর ইত্যাদি।
(২) বাণিজ্য: ভাদুরি, সেঁজুতি, সুয়োদুয়ো, নৌকাপূজা প্রভৃতি।
(৩) পিতৃপূজা, সাংসারিক সুখ, ইহজীবনের সুখশান্তি: জয়মঙ্গল, জন্মাষ্টমী, মধুসংক্রান্তি, হরিচরণ প্রভৃতি।
(৪) সৌরজগৎ তিথি নক্ষত্র ও পৃথিবীবিষয়ক : মাঘমণ্ডল, অমাবস্যা, মহানবমী, পূর্ণিমা, একাদশী, দধিসংক্রান্তি, ঘৃতসংক্রান্তি, দাড়িম্ব-সংক্রান্তি অঘোর চতুর্দশী লক্ষ্মীব্রত,
(৫)মঙ্গলবার—মঙ্গলচণ্ডীব্রত, দুর্গাষ্টমী।
(৬) হিংস্র প্রাণী, বৃক্ষবন্দনা, পশু মানানোবিষয়ক: কুলাই ঠাকুর, কার্তিক, গাড়শী, করমপূজা, তিলকুমারী, তুলসী বট, পাকুর, নিম, নল, সিজ, কলাগাছ ইত্যাদি।৪৫ উল্লিখিত ব্রতের সবগুলোই হিন্দু ধর্মের আচারের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিছু কিছু ব্রত নিরক্ষর মুসলমান সমাজেও প্রচলিত আছে ।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, ‘অশিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যেও সত্য পীরের শিন্নি, ত্রিলক্ষ পীরের শিন্নি প্রভৃতি অনুষ্ঠান প্রচলিত আছে। বশ বহু ব্রতকথাকে পুরাকাহিনীর সঙ্গে অভিন্ন বলা যায়। মেজাজে ও চারিত্র্যে, কাহিনীর গতি প্রকৃতিতে অনেক ব্রতকথাই পুরাকাহিনী। কিন্তু আমাদের দেশে এবং অনেক দেশেই পুরাকাহিনী ধীরে ধীরে ব্রতকথায় আবদ্ধ হয়ে তাদের গতিবেগ হারিয়ে ধর্মীয় আচারানুষ্ঠানের মধ্যে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এ সম্পর্কে ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেন, ‘বাংলাদেশের ব্রতকথাগুলো বিশ্লেষণ করিলেও দেখা যাইবে,
মূলত: লোককথা হইতেই ইহাদের উৎপত্তি হইয়াছিল, ইহাদের সর্বাঙ্গে এখনও সাহিত্যিক স্পর্শ অনুভব করা যায়, একটি ধর্মীয় লক্ষ্য ইহার সম্মুখে আনিয়া যেন জোর করিয়া অনেক সময় স্থাপন করা হইয়াছে বলিয়া মনে হয়। তাহার ফলেই ইহাদের আবেদনের ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হইয়া আসিয়াছে। লোককথা এইভাবে যখন কোনো সঙ্কীর্ণ ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক সীমার মধ্যে আবদ্ধ হইয়া যায়; তাহার ফলে বৃহত্তর সমাজজীবন হইতে ইহা বিচ্যুত হইয়া ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ হইয়া পড়ে। ক্রমে ইহা কেবলমাত্র আচারগত উদ্দেশ্য