উপন্যাস পিতামহ বঙ্গ জার্নাল

পিতামহ উপন্যাস বই রিভিউ সাব্বির জাদিদ

‘পিতামহ’ আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর পিতামহ, মক্কার কিংবদন্তি কুরাইশ নেতা আবদুল মোত্তালিবের জীবনাশ্রিত ঐতিহাসিক উপন্যাস বা হিস্টরিকাল ফিকশন। নবী জন্মের পূর্ববর্তী জাহিলি আরবের ইতিহাসকে কল্পনার ছোঁয়ায় অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক সাব্বির জাদিদ।

শিরোনামঃ পিতামহ উপন্যাস বই রিভিউ সাব্বির জাদিদ

বই পিতামহ
লেখক সাব্বির জাদিদ
ধরন উপন্যাস
প্রকাশনী ঐতিহ্য
মলাটমূল্য ৮০০৳
রিভিউ লেখক আতাউল হক নাসিম

★★★ পিতামহ উপন্যাস: প্রাথমিক পর্যালোচনা

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হযরত আবদুল মোত্তালিব, পাশাপাশি আরেকটা শক্তিশালী চরিত্র হলো তালহা। আইয়ামে জাহেলিয়াতের অগ্নিগর্ভ সময়ের শ্বাসরুদ্ধকর ইতিহাস যেন তালহার পায়ে পায়ে ছুটে বেড়িয়েছে বইয়ের পাতায়। কখনও তপ্ত মরুভূমিতে, কখনও মক্কা থেকে ইয়াসরিবের খেজুর বাগান, কিংবা আবার যেয়ে হাজির হবে ইয়েমেনের রাজপ্রাসাদে। কখনও অন্ধকার জেলখানায় পঁচে মরতে মরতে বেঁচে ফিরবে।

আরও পডুনঃ পথ চলার গল্প ফাতেমা নাজনীন প্রিসিলা

জাহেলিয়াতের নিষ্ঠুর বাস্তবতা যখন পাঠকের চোখের কোণ ভারী করে তুলবে, তখনই হৃদয়ে স্বস্তির নিশ্বাস হয়ে সেখানে হাজির হবেন আবদুল মোত্তালিব। কিন্তু নিপিড়ীত মানুষের চিরমুক্তি উনার হাত ধরে ঘটবে না। উনি কেবল চিরমুক্তির প্রাক পথ-প্রদর্শক। যার হাত ধরে মানবজাতির মুক্তি মিলবে, সেই মহামানবের আগমনের কথা বইয়ের শেষ পাতায় বলা আছে।

🔷🔷 পিতামহ উপন্যাস মলাটবদ্ধ থেকে কাহিনী সংক্ষেপ

‘৪৯৭ খৃষ্টাব্দে ইয়াসরিবের সবুজ ভূ-খন্ডে জন্ম নেয় এক বিস্ময়কর আরব শিশু। মাথাভর্তি সাদা চুল দেখে মা তার নাম রাখেন শাইবা। পরিণত বয়সে এই শাইবা হয়ে ওঠেন জাহিলি আরবের কিংবদন্তিতূল্য নেতা আবদুল মোত্তালিব। পিতামহ এই শুভ্রচুলের মক্কানেতা আবদুল মোত্তালিবের জীবনাশ্রিত উপন্যাস।

ইতিহাসের এমন এক সন্ধিক্ষণে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আবদুল মোত্তালিব, তার সময়কালে মক্কা স্মরণকালের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি পারি দিচ্ছিল। নবি-জন্মের পূর্বাভাস, কন্যাশিশু হত্যা, গোত্রীয় দাঙ্গা, কৌলিন্য প্রথা, প্রেম-দ্রোহ, কাব্যযুদ্ধ, দাস-ব্যবস্থা, লুটতরাজ, হস্তিবাহিনীর কাবা আক্রমণ- গোটা আরব অগ্নিগর্ভের কিনারায় অবস্থান করছিল। পিতামহ সেই অগ্নিগর্ভ সময়ের দলিল।”

📙📙📙 উপন্যাস হিসেবে পিতামহ

বাংলাদেশের অনেক খ্যাতিমান লেখকের লেখায় অনেকেই বলে থাকেন ‘সাহিত্য’ নেই। আমি অবশ্য জানি না সাহিত্য কাকে বলে? আমার কাছে সাহিত্য সেটাই যা মানুষের মনের সুন্দর অনুভূতিগুলো ফুটিয়ে তোলে, সমাজের চিত্র এমন ভাবে তুলে ধরে যা পাঠকের মনে দাগ ফেলে। কালের স্রোতে ভেসে থাকা ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রের কোন গৌরবের ঘটনা বা অসঙ্গতিকে শব্দ শিল্পের মাধ্যমে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা যা মানুষের বিবেককে শক্তভাবে নাড়িয়ে দিবে। কল্পনা করতে শেখাবে কিংবা সুখের অনুভূতি সৃষ্টি করবে।

কেউ কেউ পাতার পর পাতা লিখেও পাঠকের মনে নাড়া দিতে ব্যর্থ হন। আবার কারও লেখায় কুঁড়ে ঘরের বারান্দায় বসে পেঁয়াজ কাঁচামরিচ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার বর্ণনাও অপার শিল্পের প্রতিচ্ছবি হয়ে ফুটে ওঠে। সেই হিসাবে পিতামহ সফল। বই পড়ার শেষ পর্যায়ে আমার মনে বারবার উকিঝুকি দিচ্ছিল, এত দ্রুত কেন শেষ হচ্ছে! এখানেই লেখকের সার্থকতা। ৫২৪ পৃষ্ঠার বই পড়েও বিন্দুপরিমান ক্লান্তি আসেনি। বরং মন চাচ্ছিলো আরও বহু সময় ধরে পড়া চালিয়ে যাই।

বাবার হৃদয়ে সবচেয়ে কোমল জায়গা জুড়ে থাকে কন্যার অবস্থান। কিন্তু জাহিলি আরবের সেই অভিশপ্ত সময়ে একজন বাবা বাধ্য হয়ে কন্যাকে জীবন্ত কবর দিতেন। একজন ভাইয়ের স্নিগ্ধ ভালোবাসা থাকে তার আদরের বোনের জন্য। জীবন্ত কবর হওয়া বড় দুই বোনের জন্য তালহার হাহাকার আর ছোটবোন হুমায়রার অপমানের প্রতিশোধ নিতে উন্মত্ত তালহার তলোয়ারের ঝংকার পাঠককে তালহার স্থানে নিয়ে দাঁড় করাবে।

একটা বড় লেখা কিংবা কবিতার সব পঙক্তি সমানভাবে দাগ কাটতে পারে না। আবার কখনও ছোট একটা বাক্য হাজারও শব্দের গুরুত্ব বহন করে।
যেমন, হজ্বের সময় কাবাঘর তাওয়াফ শেষে তালহার বোন হুমায়রার একটা ঘটনার পরিণতি লেখক উপস্থাপন করেছেন এভাবে-
“মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে কাবার ছায়ায় ও যখন ফোঁপায়, তখন সিদরাতুল মুনতাহা নামের আয়ুবৃক্ষ বেদনায় কাঁপতে থাকে। হুমায়রার নাম ঠিকানা লেখা সিদরাতুল মুনতাহার পাতাটা সবার অগোচরে হলুদ হতে শুরু করে।”

আবার তালহার সবচেয়ে কাছের অন্তরঙ্গ বন্ধু কায়েসের একটা মারা ত্মক ভুলের বিষয়ে লেখকের মন্তব্য এমন ছিল- “বেদনায় বমি করতে থাকা এই সন্তানের দিকে সময় বড় পরিহাসের চোখে তাকায়। পরিহাস এই কারণে- যার মা লুট হয়ে যায় লুটেরার হাতে, তাকে পৃথিবীর বুকে সাবধানে পা ফেলে চলতে হয়। বোকা কায়েস সাবধানতা অবলম্বন করেনি। এমন সন্তানের জন্য পরিহাস ছাড়া আর কিছু জমা রাখে না সময়।”

উপরের বর্ণিত ঘটনাগুলো পড়ে সময় ভ্রমণে ডুবে থাকা পাঠকের বিবেকই সিদ্ধান্ত নিবে তার অনুভূতি কিরকম হবে।

উপন্যাস বা নাটকে এ জাতীয় ঘটনাকে সাহিত্যিক টার্মের ভাষায় বলা হয় “Irony of fate” কিংবা নিয়তির পরিহাস। যে সাহিত্যকর্মে ভবিতব্য বা বৈশ্বিক-সামাজিক কর্মপদ্ধতিকে এমন ভাবে দেখানো হয় যা চরিত্রের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে।
ভিক্টোরিয়ান যুগের অতি গুরুত্বপূর্ণ একজন ঔপন্যাসিক ছিলেন থমাস হার্ডি। তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘Tess of the D’Urbervilles’-এ যেমন আমরা দেখেছি উপন্যাসের নায়িকা টেস তার সতীত্ব হারায় নিষ্পাপ সারল্যের জন্য, সুখ বিসর্জন দেয় নিজ সততার কারণে, সাময়িক সুখ খুঁজে পায় হত্যার মাধ্যমে এবং ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলে ঘটে তার জীবনাবসান। হার্ডি উপসংহার টানেন এভাবে: “The President of the Immortals, in Aeschylesn phrase, has ended his sport with Tess.”

আরও দেখুনঃ অন্তিম উপন্যাস লতিফুল ইসলাম শিবলী

গভীর সাহিত্যের এমন অনেক উপাদান পাঠক খুঁজে পাবে পিতামহ উপন্যাসে। যা একটি উৎকৃষ্ট সাহিত্যকর্ম হিসেবে পিতামহের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করে।

ভালোবাসা-
পৃথিবীর সুন্দরতম অনুভূতির নাম প্রেম, ভালোবাসা।
হোক দাস, কিংবা নিষ্ঠুর রাজা। মানুষের মন মানেই সে ভালোবাসবে, প্রেমে পড়বে, ভালোবাসার সম্মান রক্ষায় থাকবে সচেতন।

আর সাহিত্যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, উইলিয়াম শেকসপিয়ার থেকে দস্তয়েভস্কি, সে থেকে পিতামহের লেখক সাব্বির জাদিদ, “সবাই ভালোবাসার বর্ণনা দিয়েছেন একই সুন্দর পথে, মনের যে পথে মানুষ হেটে চ লে তার প্রে মের হাত ধরে।”

সাফিয়া বিনতে উমাইয়ার সাথে তালহার অসম প্রেমের বর্ণনা, কিংবা একে অন্যের জন্য কায়েস ও হুমায়রার অন্ধ অনুভূতি পাঠকের অবচেতন মনে একটা মুচকি হাসি ফুটিয়ে তুলবে। শত যন্ত্রণা, অত্যাচারের মাঝেও মানুষ ভালো থাকে তার ভালোবাসায়। ভালোবাসা আছে বলেই পৃথিবীর বুকে আজও রঙিন ফুল ফোঁটে। লেখক সেই ভালোবাসাকে শব্দ শিল্পের ছোঁয়ায় মহিমান্বিত করেছেন পিতামহ বইতে।

কেউ কেউ রগরগে যৌনতার বর্ণনার মধ্যে উৎকৃষ্ট সাহিত্যমান খুঁজে পান! কিন্তু সাব্বির জাদিদ অত্যন্ত মানবিক ভাষায় সুন্দরভাবে প্রেম আর মানব মনের সুন্দর অনুভূতিগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার “দূরন্ত আশা” কবিতায় লিখেছেন,

“ইহার চেয়ে হতেম যদি
আরব বেদুইন
চরন তলে বিশাল মরু
দিগন্তে বিলিন!
ছুটেছে ঘোড়া, উড়েছে বালি
জীবনস্রোত আকাশে ঢালি
হৃদয়তলে বহ্নি জ্বালি
চলেছি নিশিদিন।
বর্শা হাতে, ভরসা প্রাণে,
সবাই নিরুদ্দেশ
মরুর ঝড় যেমন চলে
সকল বাধাহীন।”

তিনি কেন আরব বেদুইন হবার ইচ্ছা পোষণ করেছেন সেটা ভিন্ন আলাপ। তবে পিতামহ পড়ার পর দীর্ঘ সময় কবিতাটা আমার মাথায় ঘুরেছে।

বাংলাদেশে বসে বাংলা ভাষায় আরবের সমাজ, প্রকৃতি এমন ভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব তা পিতামহ না পড়লে বোঝা যাবে না। প্রতিটা দৃশ্যপটের বর্ণনা ক্ষণিকের জন্য হলেও হয়তো পাঠককে কবিগুরুর মতো চিন্তা করাবে।

📖📖📖 পিতামহ উপন্যাস ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

উপন্যাসের কাহিনী সেই অতীত সময়কে উপজীব্য করে লেখা, যখন আবদুল মোত্তালিব ভরাট স্বরে সম্রাট আবরাহাকে বলেছিলেন-
“আমি উটের মালিক, তাই আমার চিন্তা উট নিয়ে। কাবাঘরের যিনি মালিক, তিনি তার ঘর সামলাবেন।”

আবাবিল পাখির ঝাঁক যখন মক্কার আকাশ কালো করে আবরাহার হস্তিবাহিনীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো, আমি আবেগাপ্লুত হয়েছিলাম। মনে মনে শুনতে পাচ্ছিলাম-
– “আপনি কী দেখেননি আপনার পালনকর্তা হস্তিবাহিনীর সাথে কিরূপ ব্যাবহার করেছিলেন?” [সূরা ফীল, আল-কোরআন ১০৫:১]

উপন্যাসকে হৃদয়গ্রাহী করে তুলে ধরবার প্রায় সব ধরনের উপাদান উপস্থিত আছে পিতামহে, এবং নিঃসন্দেহে বাংলায় লেখা অন্যতম সেরা ঐতিহাসিক উপন্যাস এটি। বাংলা সাহিত্যে এমন কাজ আমরা অনেক বেশি প্রত্যাশা করি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পিতামহ উপন্যাসটি স্থায়ী এবং শক্তিশালী স্থান করে নিবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

পাঠ প্রতিক্রিয়া

নিঃসন্দেহে পিতামহ বাংলা উপন্যাসের জগতে তার আপন তেজষ্ক্রিয়তায় উচ্চতর আসনে আসীন হবে।

people also search: পিতামহ উপন্যাস pdf .পিতামহ উপন্যাস boi . পিতামহ উপন্যাস বই ডাউনলোড ।

 

সোর্স – বঙ্গ জার্নাল