কিংবদন্তি অর্থ কি? কিংবদন্তি মানে কি
কিংবদন্তি শব্দটির আভিধানিক অর্থ জনশ্রুতি, জনবর, গুজব ইত্যাদি। লােকসাহিত্যে কিংবদন্তির সংখ্যা লােকপুরাণ কিংবা লােককথার সঙ্গে তুলনামূলকভাবে কম। কিংবদন্তিতে যে কাহিনী বিবৃত হয়, লােকসমাজ মনে করেন একদিন তা ঘটেছিল, সেই ঘটনা তাঁদেরই এলাকায় সংঘটিত হয়েছিল, তাই কিংবদন্তির মধ্যে ইতিহাসের ক্ষীণ সূত্রের সন্ধান মিলতে পারে। যেমন ধরা যাক কোনাে বীর মানুষের জীবনকথা।
এই মানুষটি একদিন তাঁর ত্যাগ-শৌর্য-বুদ্ধিতে সমাজে জীবিত অবস্থাতেই প্রায় দেবতা হয়ে উঠেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে ঘিরে সম্ভব-অসম্ভব গল্প রচিত হয়ে মুখে মুখে প্রচারিত হতে থাকে। কিন্তু বহু পুরুষ-পরম্পরায় আজ আমরা সেই কাহিনীর রূপকে যে অবস্থায় পাচ্ছি, তাতে তার মধ্যে থেকে ইতিহাসের সূত্র অনুসন্ধান করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। হয়তাে বা হারকিউলিস এবং প্রমিথিউসও ঐতিহাসিক ব্যক্তি ছিলেন।
কিন্তু কিংবদন্তিতে এদের যে কাহিনী আমরা পাই তার মধ্যে ইতিহাসের কোনাে সত্য আবিষ্কার করতে যাওয়া মূঢ়তা। শুধু এটুকু অনুভব করা যায়, তারা ছিলেন অসীম শক্তিশালী ও মানবদরদী, দুষ্টের দমনে সদা ব্যগ্র। রাজস্থানের বীর মহারাণাদের নিয়ে অসংখ্য কিংবদন্তি রয়েছে। সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতৃদ্বয় সিধাে-কানহু, মুণ্ডা বিদ্রোহের অমর নায়ক বিরসা ভগবান, বাংলার রঘু ডাকাত প্রমুখ মানুষকে ঘিরে অঞ্চল বিশেষে এরকম অনেক কিংবদন্তির জন্ম হয়েছে, প্রাথমিক অবস্থায় কিংবদন্তির মধ্যে ইতিহাসের সত্যরূপ অবশ্যই থাকে, কিন্তু পরবর্তীকালে পল্লবিত হতে হতে ইতিহাস প্রায় মুছে যায়।
আরও পড়ুনঃ বনলতা সেন কবিতা
রয়ে যায় সম্ভব-অসম্ভবের এক অপরূপ কাহিনী। অনেক ঐতিহাসিক প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার সময় অসংখ্য কিংবদন্তিকে গ্রহণ করেছিলেন। ফলে এইসব ইতিহাসগ্রন্থও প্রায় কিংবদন্তির স্তরে পৌছে গিয়েছিল। কিংবদন্তিতে যেসব চরিত্র রয়েছে সেগুলাে পুরাকাহিনীর চরিত্রগুলাের মতাে নির্বিশেষে নয়, বরং এদের বিশেষ পরিচয় থাকে। লােকপুরাণের মধ্যে মানুষের সংস্কৃতি।
বিকাশের যেসব কাহিনী পাওয়া যায়, তাদেরই মধ্যে সংস্কৃতি ধাতা বা কালচার হিরাে। হিসেবে যেসব চরিত্র দেখা যায় পরবর্তীকালে তাদেরই ভাবাদর্শে কিংবদন্তির নায়কদেরও কল্পনা করা হয়। বাংলায় নির্ভেজাল কিংবদন্তি প্রায় নেই বললেই চলে। গীতিকার মধ্যে যে কাহিনীগুলাে রয়েছে তা কখনাে কখনো কিংবদন্তি থেকে গৃহীত। বাংলার বিখ্যাত মৈমনসিংহ, পূর্ববঙ্গ গীতিকা, গােরক্ষনাথ মীননাথ,
গােপীচঁাদ- ময়নামতি-মানিকচঁাদ প্রভৃতি গীতিকার আদি উৎস বাংলার পল্লীতে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য কিংবদন্তি। প্রতিটি লােকসমাজেই কিন্তু কিংবদন্তি থাকবেই । গুপ্তধনের সন্ধান, কোনাে বীরের করুণ-আত্মত্যাগ, ধ্বংসপ্রাপ্ত কোনাে নগরীর কথা, অভিশপ্ত প্রাসাদ-শ্মশান-হ্রদের গভীর তলদেশ, পাহাড়, বনভূমি প্রভৃতি রূপান্তরিত হয়ে আসে কিংবদন্তির কাহিনীতে কিংবদন্তিকে বিশ্লেষণ করলে লোেকসমাজের মানসিক প্রবণতা লক্ষ্য করা যাবে।
সেই সমাজের আগ্রহ ও কল্পনা লুকিয়ে থাকে কিংবদন্তির দেহে। কিংবদন্তির উদ্ভব নিয়ে নানা মত প্রচলিত আছে। তবু একথা সর্বজনস্বীকৃত যে, পুরাকাহিনীর অনেক পরবর্তীকালে এর জন্ম। মানুষ তখন আদিম জীবন থেকে অনেক দূরে অগ্রসর হয়ে এসেছে। পুরাকাহিনীর কল্পকথার অতিলৌকিক স্তরের পরে যখন বাস্তব কিছু ইতিহাসবােধ সমাজের মধ্যে দানা বাঁধতে শুরু করেছে তখনই এসব কিংবদন্তির জন্ম হয়েছে। অবশ্য আজ তাদের যে রূপে আমরা দেখছি সেরূপ পরিবর্তিত হয়েছে বার বার বহু সময় ধরে।
আমার দেখা নয়াচীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
লােককথার অন্তর্বিলীন অলৌকিকতার উপকরণগুলাের সরণি ধরেই কালক্রমে কিংবদন্তির অভ্যুদয় । ইতিহাসভিত্তিক কিংবদন্তিগুলাের কিছু কিছু বিবরণ স্থানীয় ইতিহাস বা মুদ্রিত সূত্রে পাওয়া গেলেও একে ঠিক ইতিহাস বলা যাবে না। বরং বলা যায় কিংবদন্তি হলাে কাঁচামাল, ইতিহাস তা হেঁকে হেঁকে আসল ঘটনা উদঘাটন করতে পারে। আমাদের দেশে গাঁথা, লােককাহিনী, প্রবাদ, ছড়া, গান, মন্ত্র ইত্যাদি লােক-ঐতিহ্যের বিভিন্ন শাখার মাল-মশলা যেমন সংগৃহীত হয়েছে, কিংবদন্তি ততটা হয়নি।
👉 বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী pdf