বাংলার লােকছড়া

বাংলার লােকছড়া কি ? লোকছড়া কাকে বলে ?

বাংলা লােকছড়া : মৌখিক আবৃত্তির জন্য মুখে মুখেই যাহা রচিত হয়, তাহাই ছড়া।এই লোকছড়া সম্পর্কিত তাত্ত্বিক আলােচনায় অগ্রণী পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “ছড়া’র একটা। স্বতন্ত্র রাজ্য আছে। সেখানে কোনাে আইন-কানুন নেই- মেঘরাজ্যের মতাে। এ সম্পর্কে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ মতামত ও মন্তব্যসমূহের সার-সংকলন নিম্নরূপ :

‘ইহার মধ্যে ভাবের পরস্পর সম্বন্ধ নাই… কতকগুলি অসংলগ্ন ছবি নিতান্ত সামান্য প্রসঙ্গসূত্র অবলম্বন করিয়া উপস্থিত হইয়াছে। ‘গাম্ভীর্য নয়, অর্থের মারপ্যাচ নয়, সুরময় ধ্বনিই ছড়ার প্রাণ।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর। ছেলে-ভুলানাে ছড়া’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘আমি ছড়াকে মেঘের সহিত তুলনা করিয়াছি। উভয়েই পরিবর্তনশীল, বিবিধ বর্ণে রঞ্জিত, বায়ু স্রোতে যদৃচ্ছ ভাসমান। দেখিয়া মনে হয় নিরর্থক। ছড়াও কলা-বিচার শাস্ত্রের বাহির মেঘবিজ্ঞান ও শাস্ত্র-নিয়মের মধ্যে ভালাে করিয়া ধরা দেয় নাই। অথচ জড়-জগতে এবং মানব জগত এই দুই উচ্ছঙ্খল অদ্ভুত পদার্থ চিরকাল মহৎ উদ্দেশ্য সাধন করিয়া আসিতেছে।

আরও দেখুনঃ লােককথা কি লোক কথা কাকে বলে?

মেঘ বারিধারায় নামিয়া আসিয়া শিশু-শস্যকে প্রাণদান করিতেছে এবং ছড়াগুলােও স্নেহরসে বিগলিত হইয়া কল্পনা বৃষ্টিতে শিশু হৃদয়কে উর্বর করিয়া তুলিতেছে। লঘুকায় বন্ধনহীন মেঘ আপন লঘুত্ব এবং বন্ধনহীনতা গুণেই জগদ্ব্যাপী হিত সাধনে স্বভাবতই উপযােগী হইয়া উঠিয়াছে, এবং ছড়াগুলিও ভাবহীনতা অর্থবন্ধন শূন্যতা এবং চিত্র বৈচিত্র্য বশতই চিরকাল ধরিয়া শিশুদের মনােরঞ্জন করিয়া আসিতেছে শিশু মনােবিজ্ঞানের কোনাে সূত্র সম্মুখে ধরিয়া রচিত হয় নাই। আমাদের অলংকারশাস্ত্রে নয় রসের উল্লেখ আছে।

কিন্তু ছেলে ভুলানাে ছড়ার মধ্যে যে রসটি পাওয়া যায়, তাহা শাস্ত্রোক্ত কোনাে রসের অন্তর্গত নহে।… ছেলে ভুলানাে ছড়ার মধ্যে তেমনি একটি আদিম সৌকুমার্য আছে সেই মাধুর্যটিকে বাল্যরস নাম দেওয়া যাইতে পারে । তাহা তীব্র নহে, গাঢ় নহে, তাহা অত্যন্ত সিন্ধ সরস এবং “যতিকে কেবল বিরতির স্থান না দিয়ে তাকে পূর্তির কাজে লাগাবার অভ্যাস আরম্ভ হয়েছে আমাদের ছড়ার ছন্দ থেকে।

ছড়া আবৃত্তি করবার সময় আপনি যতির যােগান পর আমাদের কান … ছড়ার রীতি এই যে, সে কিছু ধ্বনি জোগায় নিজে, কিছু আদায় ছড়ার ছন্দ প্রাকৃত ভাষার ঘরাও ছন্দ।… এর ভঙ্গিতে এর সজ্জায় কাব্য সৌন্দর্য। সহজে প্রবেশ করে। কিন্তু সে অজ্ঞাতসারে। এই ছড়ায় গভীর কথা হালকা চাল পায়ে।

নূপুর বাজিয়ে চলে, গাম্ভীর্যের গুমাের রাখে না।…. ছড়ার ছন্দকে চেহারা দিয়েছে । শ্ৰীকৃত বাংলা শব্দের চেহারা।… বাংলা প্রাকৃত ভাষায় হসন্ত প্রধান ধ্বনিতে ফাঁক। যুক্তি সংগতিহীন । করে কণ্ঠের কাছ থেকে; এই দুইয়ের মিলনে সে হয় পূর্ণ। | বুঝিয়ে শব্দগুলােকে নিবিড় করে দেয়।

সাহিত্য-বিচারে বাংলার বিশাল ছড়াসম্ভারকে প্রধানত

দুটি অংশে বিভক্ত করা যায়:

(১) লােকছড়া এবং

(২) আধুনিক ছড়া।

তবে এখানে ব্যবহৃত লােকছড়া শব্দটির ব্যাখ্যা প্রদান আবশ্যক। সংজ্ঞা দিয়ে বলা যায় : ছড়ার যে অংশটি অজ্ঞাত রচয়িতার মৌখিক সৃষ্টি তাই লােকছড়া। এই অর্থে লােক ছড়া স্পষ্টতই লােকসাহিত্যের অন্তর্গত। লক্ষণীয় যে শতবর্ষের ছড়া চর্চায় এর কোনাে পৃথক নামকরণ ঘটেনি। আলােচকগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘লােকসাহিত্যের ছড়া’ নামে এক শনাক্ত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেকে আবার এ ছড়াকে ছেলে ভুলানাে ছড়া বা মেয়েলি ছড়া বলে অভিহিত করেছেন। লক্ষণীয় যে ইংরেজি ভাষায় লােকসাহিত্যের সমগ্র ছড়া অংশকে ধারণ করতে পারে এমন কোনাে শব্দ নেই।

লােকসঙ্গীত কাকে বলে ? লােকসঙ্গীত কি?

ছড়ার ক্ষেত্রে ইংরেজিতে প্রকৃতি ভেদে

  • Nursery rhyme,
  • Game song,
  • Dance song,
  • Lullaby,
  • cradle song

প্রভৃতি নাম ব্যবহৃত হয়। কিন্তু লােকসংস্কৃতির অন্যান্য অংশের পৃথক ইংরেজি নাম রয়েছে।

লােকসাহিত্যের ইংরেজি অর্থ?

লােকসাহিত্য Flok-literature; লােক নৃত্য= Flok-dance; লােক-সঙ্গীত Folk-song : লােককাহিনী = Flok-tale প্রভৃতি। প্রদত্ত নামসমূহের পাশাপাশি লােকছড়া নামকরণ অত্যন্ত স্বাভাবিক বলেই মনে হয়।

বাংলার লােকছড়া শব্দটি শ্রবণ মাত্রই দুটি ভাব জাগ্রত হয় : একটি লােকসাহিত্যের ছড়া অংশ; এবং অপরটি ছড়াসমগ্রে লােকসাহিত্যের অন্তর্গত অংশ। এই উভয় ভাবই লােকছড়া-সংক্রান্ত ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

লােক ছড়ার বৈশিষ্ট্য

বাংলার লােকছড়া কি জানার পর আসে যে লোক ছড়া বৈশিষ্ট্য লােক ছড়ার বৈশিষ্ট্য রবীন্দ্র-ভাবনায় ছড়া সম্পর্কিত বৈশিষ্ট্যের নির্যাস দাঁড়ায় নিম্নরূপ :

১. ছড়া নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুনের অধীন নয়;

২. ছড়ার ভাব পরস্পর সম্বন্ধহীন ও যুক্তি সঙ্গতিবিহীন;

৩. ছড়ার চিত্র অসংলগ্ন

৪. অর্থবােধের চেয়ে সুরময় ধ্বনিই ছড়ার প্রাণস্বরূপ;

৫. ছড়া কলা বিচার শাস্ত্র কিংবা শাস্ত্রীয় রসে বিচার্য নয়;

৬. ছড়ায় যতির ভূমিকা শুধু বিরতির জন্য নয়; এবং

৭. ছড়ার ছন্দ প্রাকৃত ভাষার ছন্দ এবং শব্দও প্রাকৃত।

বাংলার লােকছড়া শ্রেণিবিন্যাস বাংলা লােকছড়ার শ্রেণিবিভাগ দুরূহ এবং জটিল। ছড়া-চর্চার পথিকৃৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলার লােকছড়া কে  নিম্নোক্ত দুইভাবে বিভক্ত করেছিলেন।

জীবনানন্দ দাশ কে  তার আত্বপরিচয়

১. মেয়েলি ছড়া;

২. ছেলে ভূলানাে ছড়া। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি তাঁর সমস্ত সংগৃহীত ছড়াকে ‘ছেলে ভুলানাে ছড়া” শিরােনামে বিন্যস্ত করেন।

ছেলে ভুলানাে ছড়া

ঘুম পাড়ানি ছড়াগুলাের সঙ্গে ছেলে ভুলানাে ছড়াগুলাে মৌলিক পার্থক্য আছে। উভয়ের জননী কিংবা শিশুধাত্রীর রচিত বলে পরিণত রস মানসের স্পর্শে সমুজ্জ্বল হলেও, নিদ্রার প্রয়ােজনে এক শ্রেণির ছড়া রচিত হয়ে থাকে এবং জাগ্রত জীবনের প্রয়ােজনে আর এক শ্রেণির ছড়া রচিত হয়ে থাকে। সুতরাং উভয়ের রস এক এবং অভিন্ন হতে পারে না। ঘুমপাড়ানি ছড়াগুলাের মধ্য দিয়ে দীর্ঘায়িত স্বরের বিলম্বিত উচ্চারণ, ছেলে ভুলানাে ছড়াগুলাের মধ্য দিয়ে সংক্ষিপ্ত মাত্রার, দ্রুত, স্বরাচ্চারণ শুনতে পাওয়া যাবে।

ঘুমপাড়ানি ছড়াগুলাে দীর্ঘ মাত্রার পদ দ্বারা গঠিত, তাদের তুলনায় সাধারণ ছেলে ভুলানাে ছড়াগুলাে অল্প মাত্রার ছন্দে রচিত। ‘ছেলে ভুলানাে ছড়াগুলাে’ শিশু সম্পর্কিত হলেও এর আবৃত্তিকারিণী শিশু নয়, জননী। যতদিন পর্যন্ত শিশুর মুখে ভাষা থাকে অস্কুট ততদিন জননীই ছড়া বলে শিশুকে ভুলিয়ে রাখেন। সংসারে, দিনে দশ রকম কাজ করতে হয় মাকে। যে সমস্ত কাজে বাধা পড়ে যদি শিশু সর্বদা দুরন্তপনা বা কান্নাকাটি করে। সে কারণে হাতে কাজের চাপ থাকলে মা শিশুকে ঘুমপাড়াতে বসেন।

দু হাঁটুর উপর শিশুকে শুইয়ে মৃদু মৃদু দোলাতে দোলাতে অপূর্ব সুরের মায়াজাল সৃষ্টি করেন; শিশুর দেহ দুলতে থাকে, দুষ্টুমি বা কান্না ক্রমে থেমে যায়, মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সুরের সেই মায়াজালে সে জড়িয়ে পড়ে। এ জন্য ছেলেভুলানাে ছড়ায় রােমান্সের স্পর্শ আছে। ছেলেকে ভুলাবার জন্য মাকে নানা রকমের ফন্দি-ফিকির করতে হয় বলে এই জাতীয় ছড়ার শিশুর চরণ-সঞ্চালনের মতাে সংক্ষিপ্ত মাত্রার দ্রুত স্বরােচ্চারণ শােনা যায়। বিষয় বিশ্লেষণে এর মধ্যে পাওয়া যায়, যথাক্রমে- ক. ছেলে ভুলানাে ছড়া পরিবর্তনশীল।

এই ধরনের ছড়া রচনার ক্ষেত্রে কোনাে বিশেষ উদ্দেশ্য থাকে না, অকারণ আনন্দরস এতে অভিব্যক্তি লাভ করে  সমাজদেহে সুগভীর ভাবে প্রকাশ করার পরিবর্তে সঞ্চরণশীল মেঘের মতাে উপরিস্তরে যথেচ্ছা ভেসে বেড়ায়, অথচ এর মধ্যে দিয়ে অলক্ষে সুমহান সামাজিক উদ্দেশ্যও সাধিত হয়।

ছেলেভুলানাে ছড়া লঘুভার, অর্থহীন ও বিচিত্র ধরনের বলে শিশু-হৃদয় সহজে অধিকার করেও চিরন্তনত্ব লাভ করে। ছেলে ভুলানাে ছড়া উদাহরণ 

ছেলে ভুলানাে ছড়া উদাহরণ 

 ‘খােকন খােকন ডাক পাড়ি,

খােকন গেছে কাদের বাড়ি

আয়রে খােকন ঘরে আয় দুধমাখা ভাত কাকে খায়।

অথবা,

 কিসের লাগি কান্দো খােকা কিসের লাগি কাঁন্দো কিইবা

নেই আমার ঘরে।

আমি সােনার বাঁশি বাঁধিয়ে দেব

মুক্ত থরে থরে৷

থরে থরে মুক্তা দিয়ে বাঁধানাে সােনার বাঁশির প্রলােভন দেখিয়ে শিশুর কান্না ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।

এখানে- শিশু যখন হাঁটতে শেখেনি, দু পায়ের ভর দিয়েও দাঁড়াতে অক্ষম, তখন মা দু- হাতে শিশুকে তুলে ধরেন, নাচান। আর শিশু তার ক্ষুদ্র দু’খানি চরণ বার বার মাটি স্পর্শ করে আঘাত করতে থাকে শিশুকে এভাবে নাচানাে বা শিশুর এই নৃত্য একাধারে জননী ও শিশুর উভয়েরই আনন্দের কারণ :

খােকা নাচে কোন্ খানে; শতদলের মাঝখানে।

যেখানে খােকা চুল ঝড়ে, থােকা থােকা ফুল পড়ে ।

তাই নিয়ে খােকা খেলা করে এই পর্যায়ের ছড়াগুলােতে বাৎসল্যরস শত ধারায় উৎসারিত শিশু নারায়ণের দিকে তাকিয়ে মা যেন অনুভব করেন বড় সাধনার ধন সন্তান যেন সর্বাঙ্গ দিয়ে নাচছে। এ শিশু কখনো মুরলীবদন, ককনও বা শিশু ভােলানাথ। শুধু তাই নয়, আকাশচারী পক্ষীকুল, নৌকাবিহার, ভোঁদড়-শিয়াল-শালিক ও চাদের এবং সাপের মাথায় ব্যাঙের

লোকছড়া কি লোকছড়া কাকে বলে এই নিয়ে একটি পিডিএফ দেয়া হলো বঙ্গ জার্নাল সাইট থেকে ডাউনলোড করে নেন।  লোকছড়াpdf