পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ৭টি বই (বুকরিভিউ)
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ৭টি বই (বুকরিভিউ)

পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ৭টি বই (বুকরিভিউ)

সারা পৃথিবীতে এ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া কতোগুলো প্রাচীন বইয়ের কথা বলবো আজকে। বইগুলোর লেখকদের নাম অজানা এবং কোন বিষয়ের উপর বই গুলো লেখা হয়েছিল সেটাও অনেকটাই অজানা। বইগুলো আধুনিক সময়ের বইয়ের মতো চকচকে কাগজের বাঁধাই করা বই নয়, তবে বই গুলো তাদের যুগের সবচেয়ে উন্নত পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়েছিল একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। উল্লেখ্য যে, বই বিভিন্ন রকমের হতে পারে। যেমন পাথরে খোদাই করা বই (মিশরীয় সভ্যতার), পোড়ামাটির (Pottery) বই, রেশম কাপড়ে লেখা বই, প্যাপিরাসে লেখা বই, ধাতব পাতে খোদাই করে লেখা বই, চামড়ায় লেখা বই ইত্যাদি।

তবে এখানে শুধু আধুনিক যুগের বইয়ের মতো যেসব বই দুই বা ততোধিক পাতা বিশিষ্ট এবং বহন যোগ্য এবং এমন কোন সুনির্দিষ্ট বিষয়ের উপর লিখিত পান্ডুলিপি যেগুলো একটি মলাট দ্বারা আবদ্ধ অবস্থায় আছে সেসব বই বিবেচনা করা হয়েছে। চলুন বই গুলোর সমালোচনা (review) শুরু করা যাক। বই গুলোর ছবি বর্ণনার ধারাবাহিকতা অনুযায়ী সংযুক্ত।

★১) মাদ্রিদ কোডেক্স (Madrid Codex):  বিভিন্ন চিত্র ও সাংকেতিক ভাষায় লিখিত বইটি কলম্বিয়ার মায়ান সভ্যতার একটি সাংস্কৃতিক নিদর্শন। ১৮৬০ সালে স্পেনের মাদ্রিদ শহরে আবিষ্কৃত বা উদ্ধার হওয়া বইটি দৃশ্যত ইউকেতান (Yucatan) পদ্ধতিতে লিখিত। অর্থাৎ এটিতে চিত্র, সংকেত, মায়ানদের প্রচলিত ইউকাটেক ভাষা, ইৎজা ভাষা, লেকানডন এবং মোপান ভাষার সংমিশ্রণ রয়েছে।

মাদ্রিদ কোডেক্স (Madrid Codex):
মাদ্রিদ কোডেক্স (Madrid Codex):

 

বিশেষজ্ঞদের ধারণা বইটিতে ৯০০ -১৫২১ সালের মধ্যে কলম্বিয়ার মায়া সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এবং স্প্যানিশদের কলম্বিয়া অভিযানের সময় বইটি স্পেনে নিয়ে আসা হয়। বর্তমানে বইটি স্পেনের মাদ্রিদ শহরে অবস্থিত আমেরিকা জাদুঘরে (Museo de América) সংরক্ষিত আছে। বইটির বিষয়- অজানা, লেখকের নাম- অজানা। বইটির বর্তমান বয়স কমপক্ষে ৫০১ বছর।

★২) গুটেনবার্গ বাইবেল (Gutenberg Bible): ১৪৫৪ অথবা ১৪৫৫ সালে জার্মানি থেকে বইটি মেশিন ব্যবহার করে ছাপানো হয়। জোহানেস গুটেনবার্গ (Johannes Gutenberg) নামের এক ব্যক্তি বইটি মেশিন প্রিন্টার ব্যবহার করে একটি বিশেষ কায়দায় ছাপান, যাতে প্রতিটি পাতায় ৪২ টি করে চরণ বা লাইন রয়েছে।

গুটেনবার্গ বাইবেল (Gutenberg Bible)
গুটেনবার্গ বাইবেল (Gutenberg Bible)

বিশ্বে এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে পুরাতন মেশিনে ছাপানো বই হিসেবে এটির গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড রয়েছে। এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে বইটির ৪৮ টি কপি পাওয়া গেছে যার মধ্যে ২১ টি অক্ষত অবস্থায় আছে। ছবির বইটি আমেরিকার নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত। বিষয়ঃ খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ। বয়স-৫৬৬ বছর।

★৩) বুক অব কেলস বা সেলটিক সেলটার (Celtic Psalter):: স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে (ট্রিনিটি কলেজ) সংরক্ষিত পকেট আকারের বইটিকে বলা হয় বুক অব কেলস (Book of Kells)। অত্যান্ত সূক্ষ্ম নকশা ও কারু চিত্রের মাধ্যমে বইটির প্রথম দিকের কিছু পৃষ্ঠা অলংকৃত করা হয়েছে। ল্যাটিন ভাষায় লিখিত বইটি ইউরোপিয়ান ক্যালিগ্রাফির একটি অনন্য নিদর্শন।

বুক অব কেলস বা সেলটিক সেলটার (Celtic Psalter)
বুক অব কেলস বা সেলটিক সেলটার (Celtic Psalter)

স্কটল্যান্ডের কেলস্ এলাকায় বইটির সন্ধান পাওয়ায় এটিকে বুক অব কেলস নামে ডাকা হয়। ৬৮০ পৃষ্ঠার বইটিতে বাইবেলের ৪টি গসপেল (অধ্যায়) বর্ণিত হয়েছে। আনুমানিক ৮০০ সালে বইটি খৃস্টান সন্যাসীদের হাতে লিখিত, তবে লেখকের নাম অজানা। বইটির বর্তমান বয়স আনুমানিক ১২২১ বছর। ছবিতে কারুকাজ এবং লিখিত পৃষ্ঠা দেখানো হয়েছে।

★৪) সেইন্ট কাটথবার্ট গসপেল (St Cuthbert Gospel): পকেট আকারের (৫.৪×৩.৬ ইঞ্চি) এই বইটিকে প্রাচীন ইংল্যান্ডের একজন খৃষ্টান ধর্মীয় নেতা সেইন্ট কাটথবার্ট এর মৃতদেহের কফিনের ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে নর্থআম্বারল্যান্ড দ্বীপে কবর দেয়া হয়েছিল আনুমানিক ৬৯৮ সালে। কিন্তু ভাইকিংসরা (Viking) একসময় ঐ দ্বীপ থেকে বইটি চুরি করে নিয়ে যায়। দীর্ঘ কাল নিখোঁজ থাকার পর ১১০৪ সালে কিছুটা সংস্কার করা অবস্থায় আবারো বইটির সন্ধান পাওয়া যায়।

সেইন্ট কাটথবার্ট গসপেল (St Cuthbert Gospel
সেইন্ট কাটথবার্ট গসপেল (St Cuthbert Gospel

পরবর্তীতে ২০১২ সালে বৃটিশ লাইব্রেরি ৯ মিলিয়ন পাউন্ড (১০৪ কোটি টাকা প্রায়) দিয়ে চামড়ায় বাঁধাই করা বইটি কিনে নেয় এবং বৃটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষন করে এবং পাঠকের জন্য বইটির হুবহু ডিজিটাল ভার্সন বের করেছে।
বিষয়ঃ পবিত্র বাইবেলের একটি গসপেল (গসপেল অব জন অধ্যায়)
বয়সঃ ১৩২৩ বছর (আনুমানিক)

★৫) নাগ হাম্মাদি লাইব্রেরি (Nag Hammadi Book/ Library): ১৯৪৫ সালে মিশরের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর নাগ হাম্মাদিতে স্থানীয় এক ব্যক্তি তার বাড়ি নির্মাণের জন্য মাটি খননকালে একটি বিশাল প্রাচীন কৌটা (বাক্স) আবিষ্কার করেন। সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় কৌটাটি উদ্ধারের পর দেখতে পান এর মুখ খুব ভালোভাবে পানিরোধক করে বন্ধ করা হয়েছে। মিশরবিদ (Egyptologist) রা কৌটাটি খুললেব এর ভিতর থেকে ১৩টি বই উদ্ধার করেন।
প্যাপিরাসের উপর লিখিত এবং মোটা চামড়ায় বাঁধানো দুটি পৃষ্ঠা চামড়ার সাথে লাগানো, চামড়ার মলাট খুললেই দুই দিকে দুটি পৃষ্ঠা ভাগ হয়ে যায়। ধারণা করা হয় কপটিক ভাষায় লিখিত বই গুলো ৪র্থ শতকের প্রথমার্ধে গ্রীক ভাষার কোন বই থেকে প্রতিলিপি তৈরি করা হয়েছিল। এর লিখিত বিষয় সমন্ধে সুস্পষ্ট ভাবে কিছু জানা সম্ভব হয়নি কেননা এর বেশির ভাগ অংশ পঠনযোগ্য নয়।

নাগ হাম্মাদি লাইব্রেরি (Nag Hammadi Book/ Library)
নাগ হাম্মাদি লাইব্রেরি (Nag Hammadi Book/ Library)

ধারণা করা হয় এগুলো প্রাচীন কোন পাঠাগারের অংশ, তাই এগুলোকে নাগ হাম্মাদি লাইব্রেরি নামকরণ করা হয়েছে। বইগুলো বর্তমানে মিশরের কায়রো জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। কার্বন ডেটিং থেকে জানা যায় এগুলোর বয়স আনুমানিক ১৭০০ বছর।

★৬) পিরগী গোল্ড ট্যাবলেটঃ ১৯৬৪ সালে ইটালির প্রাচীন শহর পিরগী’র (Pyrgi) একটি বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্যে খনন কাজ চলাকালে স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়া তিনটি পাত পাওয়া যায়। একপাশে তিনটি করে সমান মাপের ছোট্ট ছিদ্র বিশিষ্ট পাত গুলো হযরত ঈশা আঃ এর জন্মের ৫০০ বছর পূর্বের তৈরি করা হয়েছিল। ছিদ্র গুলো দেখে ধারণা করা হয় পাত তিনটি একসাথে বইয়ের মতো করে (Spiral) বাঁধাই করা ছিল।

পিরগী গোল্ড ট্যাবলেটঃ
পিরগী গোল্ড ট্যাবলেটঃ

দুটি পাতে এটরুস্কান (Etruscan) বর্ণমালায় কথামালা লেখা রয়েছে এবং অপরটিতে প্রাচীন ফোহেনিসিয়ান (বর্তমান লেবানন সিরিয়া ফিলিস্তিন অঞ্চল) রাজা থিফারি ভেলিয়ান্স’র পক্ষে ফোহেনিসিয়ান দেবী এস্থারতি’র প্রতি বন্দনা লেখা রয়েছে। বইটি বর্তমানে ইটালির রোম জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
বয়সঃ ২৫২১ বছর

★৭) গোল্ডেন অর্ফিজম বুক (Golden Orphism Book): ১৯৫৫ সালে বুলগেরিয়ার স্ট্রুৃমা (Strouma) নদী থেকে একটি খাল খনন কালে ২৪ ক্যারেট স্বর্ণের পাতে তৈরি একটি বই আবিস্কৃত হয়। ৬টি পাতের পৃষ্ঠায় তৈরি বইয়ের পাতাগুলো একটি রিংয়ের মাধ্যমে একত্রে সংযুক্ত আছে এবং একই রিংয়ের সাহায্যে এটিকে ঝুলানোর ব্যবস্থা আছে। এটরুস্কান (Etruscan) বর্ণমালায় লিখিত বইটিতে একটি ঘোড়া, সহিস, বীণা, সিঙ্গা এবং একজন সৈন্যের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। গবেষকদের মতে বইটি হযরত ঈসা আঃ এর জন্মের ৬৬০ বছর পূর্বে রচনা (তৈরি) করা হয়েছে।

বইটির ৬টি পাতার মোট ওজন ১০০ গ্রাম। ৭০ বছর বয়সী ব্যক্তি যিনি বইটি খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে বুলগেরিয়ার সোফিয়া শহরে অবস্থিত ন্যাশনাল মিউজিয়ামে দান করেন এবং বর্তমানে সেখানেই সংরক্ষিত আছে। (Orphism হলো পৌরাণিক দেব দেবীতে বিশ্বাসী একটি ধর্ম যা বর্তমানে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মধ্যে ইউরোপে এই ধর্ম বিশ্বাস প্রচলিত ছিল।)
বয়সঃ ২৬৮১ বছর।

লেখক – মাসুদ আলম