দেশে বিদেশে সৈয়দ মুজতবা আলী রিভিউ
ভ্রমণকাহিনী পড়ার সবচেয়ে বড় মজার দিক হলো গাঁটের পয়সা খরচ না করেই একটা দেশ, সেদেশের সংস্কৃতি এবং মানুষ সম্পর্কে জানা যায়। আর যদি সে লেখক হন কালোত্তীর্ণদের একজন তাহলে তাে কথাই নেই। সম্প্রতি পড়লাম প্রখ্যাত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা বিখ্যাত ভ্রমনকাহিনী দেশে-বিদেশে।
আরও পড়ুনঃ বনলতা সেন কাব্য ( রিভিউ )
‘দেশে বিদেশে’ লেখাটি লেখক শান্তিনিকেতনে পড়া শেষে মাত্র ২৩ বছর বয়সে যখন আফগানিস্তানে কাবুল কৃষি কলেজে ফারসি এবং ইংরেজি ভাষার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন তখনকার অভিজ্ঞতার বয়ান। সময়ের কালিক পরিক্রমায় এই বইটাকে ভ্রমনকাহিনী এবং স্মৃতিকথা উভয়ই বলা যেতে পারে। ভ্রমণকাহিনী যে কত উচু স্তরের হতে পারে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ‘দেশে বিদেশে’ বইটি ৷
শিরোনামঃ দেশে বিদেশে সৈয়দ মুজতবা আলী রিভিউ
বই | দেশে বিদেশে |
লেখক | সৈয়দ মুজতবা আলী |
প্রকাশনা | নিউ এজ পাবলিশার্স |
পৃষ্ঠা | ২৭৯ |
বুক রিভিউ লেখক | জুয়েল মল্লিক |
‘দেশে বিদেশে’র কাহিনী সংক্ষেপঃ
সময়টা ১৯২৯ থেকে ১৯৩১ পর্যন্ত ৷ লেখক সেখানে কিভাবে গেলেন, কি কি ঘটলো এবং কিভাবে ফিরে এলেন তারই চিত্তাকর্ষক বয়ান রয়েছে সৈয়দ মুজতবা আলী’র দেশে বিদেশে বইতে ৷ কাহিনীর সুত্রপাত হয় হাওড়া স্টেশন থেকে লেখকের পেশওয়ারের দিকে ট্রেনযাত্রা দিয়ে। লেখক আফগান সরকারের আমন্ত্রণে কাবুলে শিক্ষকতার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। যাত্রাপথে অপরিচিত মানুষের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে, পরিচয় থেকে হয় বন্ধুত্ব। ট্রেন যখন তীব্রগতিতে ছুটে যাচ্ছিল তিনি সতর্কদৃষ্টিতে জানালার বাইরে বাংলাদেশের পরিচিত কোনো ছবি খুঁজছিলেন। লেখকের বর্ণনায় ফুটে উঠেছে তার মুগ্ধ চিত্রায়ণ —
🔷”বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখি কাকজ্যোৎস্না। তবুও স্পষ্ট চোখে পড়ে এ বাঙলাদেশ নয়। সুপারি গাছ নেই, আম জামে ঘেরা ঠাসবুনুনির গ্রাম নেই, আছে শুধু ছেড়া ছেড়া ঘরবাড়ি এখানে সেখানে। উঁচু পাড়িওয়ালা ইদারা থেকে তখনো জল তোলা চলছে, পুকুরের সন্ধান নেই। বাংলা দেশের সোঁদা সোঁদা গন্ধ অনেকক্ষণ হল বন্ধ দমকা হাওয়ায় পোঁড়া ধুলো মাঝে মাঝে চড়াৎ করে যেন থাবড়া মেরে যায়।”
গাড়িতে প্রথমেই লেখকের সাথে আলাপ জমে উঠে মুরব্বি ড্রাইভারের সাথে যাকে লেখক সর্দারজি নামে উল্লেখ করেছেন। লেখকের সরস এবং উপভোগ্য বর্ণনায় প্রথমদিকে উঠে এসেছে পাঠানদের কথা। তাদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেখক উল্লেখ করেছেন পাঠানদের রাস্তাঘাটে ইচ্ছেমতো চলার বিষয়টি।
🔷”পাঠানমুল্লুকে লোকজন যার যে রকম খুশি সেভাবে চলে ৷ একজন খাস পাঠান কখনো কারো জন্য রাস্তা ছেড়ে দেয়না। সে ‘স্বাধীন’, রাস্তা ছেড়ে দিতে হলে তার স্বাধীনতা রইল কোথায়? কিন্তু ওই স্বাধীনতার দাম দিতেও সে কসুর করে না ৷ ঘোড়ার নালের চাট লেগে যদি পায়ের এক খাবলা মাংস উড়ে যায় তাহলে সে রেগে গালাগালি কিংবা মারামারি কিংবা পুলিশ ডাকবে না। পরম শ্রদ্ধা আর বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞাসা করবে, দেখতে পাস না ? চালক ততোধিক অবজ্ঞায় বলবে, তোর চোখ নাই ? ব্যস, এরপর যে যার পথে চলে যায়।”
গাড়ি থেকে পেশওয়ার ষ্টেশনে নামার পর লেখকের সাথে দেখা হয় তাঁর বন্ধু এবং পেশােয়ারের পুলিশ কর্মকর্তা আহমদ আলীর সাথে। তিনি আহমদ আলীর বাসায় মেহমান হিসেবে আশ্রয় নেন। মেহমানদারির মতো অন্য কোনো কিছুতে পাঠানরা এত আনন্দ পায় না তা আহমদ আলীকে দেখলে বোঝা যায়। আহমদ আলীর সাথে কাটানো সময়গুলোর মাধ্যমে লেখক তার পাঠককে পাঠান জাতি ও তাদের কৃষ্টি-কালচার, ফিরিঙ্গি এবং পাঞ্জাবিদের সম্পর্কে বয়ান দেন যা এককথায় সরস কিন্তু উপভোগ্য । তার চিত্তাকর্ষক এবং আমেজি লেখার মৌতাতে মুগ্ধ হয়েছি, মনে হয়েছে দৃশ্যকাব্যের মুগ্ধকর মঞ্চায়ন দেখছি চোখের সামনে।
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী রিভিউ
বইতে একে একে বর্ণিত হয়েছে সেই সময়কার আফগানিস্তানের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, ব্যবসা, রাজনৈতিক অবস্থার নির্মোহ বাস্তবতা। বড়ভাই ইনায়েতুল্লাহ কে পেছনে ফেলে ছোটভাই আমানুল্লাহ কি করে সিংহাসন পেলেন, কি করে বাচ্চায়ে সাকো’র কারণে আমানুল্লাহ’র পতন হল তার বিস্তারিত পরম্পরা বর্ণিত হয়েছে বইটির পাতায় পাতায়। কমবেশি প্রতিটি চরিত্রের (সর্দারজি,আহমদ আলী, খুদাবখশ, দোস্ত মুহম্মদ ও আব্দুর রহমান) চিত্রায়ণ ছিলো মুগ্ধতায় মোহাবিষ্ট হওয়ার মতো ৷ তবে লেখকের সবচেয়ে কাছে থেকে দেখা আবদুর রহমান চরিত্রের কাব্যিক চিত্রায়ণ ছিলো হৃদয়গ্রাহী ৷ পরিস্থিতির বাস্তবতায় যখন লেখক আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে দেশে ফেরার পরিকল্পনা করছেন তখন একজন মনিবের সাথে তার চাকরের (আব্দুর রহমানের) বিদায় ও বিচ্ছেদ দৃশ্যও যে এতো করুন এবং আন্তরিক হতে পারে সেটাও ফুটিয়ে তুলেছেন কাব্যিকভাবে৷ যার নির্মোহ স্বীকারোক্তি মিলেছে শেষোক্ত লাইন দুটোর মাধ্যমে, লেখক বলেন–
🔷”বহুদিন ধরে সাবান ছিল না বলে আব্দুর রহমানের পাগড়ী ময়লা ৷ কিন্তু আমার মনে হল চতুর্দিকের বরফের চেয়ে শুভ্রতর আব্দুর রহমানের পাগড়ী আর শুভ্রতম আব্দুর রহমানের হৃদয় ৷”
দেশে বিদেশে সৈয়দ মজতবা আলী বইটি ডাউনলোড করুণ নিচের লিঙ্কঃ