১৯৬৯ সালের গণ-অত্যুত্থানের কারণ ও প্রেক্ষাপট

১৯৬৯ সালের গণ-অত্যুত্থান কারণ ও প্রেক্ষাপট

প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান যখন তার শাসনের এক দশক পূর্তি উপলক্ষে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল্যায়নে ব্যস্ত ঠিক তখনই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উক্ত দশকের শােষণ নীতি ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদের ঝড় তােলে। আইয়ুব খানের শাসনের বিরুদ্ধে তাদের দারুণ ক্ষোভ ও উষ্মার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের ৬-দফা কর্মসূচি ঘােষণা এবং ১৯৬৯ সালের প্রথম দিকে ছাত্রসমাজের ১১-দফার কর্মতৎপরতা ছিল মূলত পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠীর শােষণ নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ। বস্তুত,১৯৬৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে ক্ষমতাসীন শাসকচক্রের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার আপামর জনগণ ছাত্রসমাজের পাশে দাঁড়িয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানতে থাকে। স্বল্পকালের মধ্যেই এ প্রতিবাদ এক গণ-আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে এবং জন্ম নেয় ১৯৬৯-এর গণ-অত্যুথানের। তরুণ ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এ গণ-অভ্যুত্থান নতুন উদ্যমে তীব্র গতিবেগ লাভ করে। ফলে আইয়ুব খানের ক্ষমতার ভিত অল্পদিনের মধ্যে কেঁপেওঠে এবং পরিশেষে তার সরকারের পতন ঘটে। উনসত্তরের এ গণ-অভ্যুত্থানের কারণ ছিল একাধিক এবং

তন্মধ্যে নিম্নোক্ত গণ-অত্যুত্থান কারণ ও প্রেক্ষাপট কারণগুলাে সর্বাগ্রে উল্লেখের দাবি রাখে –

১. ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে ঘােষিত সামরিক শাসনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে যেভাবে গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও বিধি-বিধান পর্যদস্ত হয় তার প্রতিবাদ হিসেবে পরবর্তীতে সূচিত হয় এ গণ অভ্যুত্থান।
২. আইয়ুব শাসনামলের সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কেবল পশ্চিম পাকিস্তানে গৃহীত হবার ফলে পূর্ব
ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে পর্বতপ্রমাণ বৈষম্যের সৃষ্টি হয় তৎপ্রতি এক ব্যাপক গণ আন্দোলনের
সৃষ্টির জন্য উনসত্তরের এ গণ অভ্যুত্থান সৃষ্টি হয়।
৩. সমগ্র পাকিস্তানে গণবিরােধী ও অশুভ শক্তির ক্ষমতা বৃদ্ধি, বিশেষত মৌলিক গণতন্ত্রী ও অন্যান্য স্বার্থান্ধ ব্যক্তিবর্গের ক্ষমতার ব্যাপক বৃদ্ধিকে প্রতিহত করবার উদ্দেশে এ গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল ।
৪. পাকিস্তানে সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের অত্যধিক প্রভাব, ক্ষমতার অপব্যবহার ও তাদের গণবিরােধী ভূমিকার প্রতিবাদ হিসেবে সূচিত হয় এ অভ্যুথান।
৫. পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগােষ্ঠীর
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়ার প্রতি ক্ষমতাসীন শাসকগােষ্ঠীর অবজ্ঞা, অনীহার প্রতিবাদস্বরূপ গড়ে ওঠে উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান।
৬. পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থবাদীদের বিরুদ্ধে উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান ছিল এক স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ।

১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এর  লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুথানের লক্ষ ও উদ্দেশ্য ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। নিচে সেগুলাে উল্লেখ করা হলাে —

১. গণতন্ত্রের পূর্ণ বাস্তবায়ন
পাকিস্তান সৃষ্টির পর হতে দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে। কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসীন কায়েমী স্বার্থবাদী গােষ্ঠী বরাবরই জনগণের এ দাবিকে পদদলিত করেছে। তথাপি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও এর পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবি থেমে থাকে নি। আওয়ামী লীগসহ দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলাের দলীয় আদর্শ ও ঘােষণাপত্রে এ দাবি অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাজনৈতিক দলগুলাের পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজও সর্বদাই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ছিল সদা সােচ্চার। সে কারণেই ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুথানেরও মূল লক্ষ্য ও একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল গণতন্ত্রের পূর্ণ বাস্তবায়ন।

আরোও পড়ুনঃ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও ১১ দফা নিয়ে যত কথা

২. পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা
পাকিস্তানের বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলাের একটি মৌলিক দাবি ছিল প্রদেশগুলােতে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করা। আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলাে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে বিভিন্ন সময় আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের ৬-দফা কর্মসূচির মূলকথাই ছিল পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। ১৯৬৯ সালে ছাত্রসমাজের ১১-দফা কর্মসূচিরও অন্যতম দাবি ছিল পূর্ব পাকিস্তানে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৬৯ সালের ষ গণ-অভ্যুত্থানের লক্ষ্যও ছিল ঠিক তাই।

৩. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ
পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠালগ্ন হতেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি হতে থাকে এবং ক্রমে তা বৃদ্ধি পেয়ে এক ব্যাপক ও গুরুতর আকার ধারণ করে। পাকিস্তানের প্রথম দশকে যদিও এ বৈষম্যমূলক আচরণের সূত্রপাত ঘটে তথাপি দেখা যায় যে, বাস্তবে আইয়ুব খানের দশকে তা পর্বতপ্রমাণ হয়ে দাঁড়ায় এবং জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রেই এ বৈষম্য প্রতিভাত হয়ে ওঠে। বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলাে এ বৈষম্যের প্রতিবাদ করে এবং তা নিরসনকল্পে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়। উনসত্তরে এ আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়।

৪. সকল গণবিরােধী ও অশুভ শক্তির মূলােচ্ছেদ করা
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে দাবিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চক্রান্তে মেতে উঠেছিল। পাকিস্তানের ২৪ বছরের ইতিহাসই তার সাক্ষ্য বহন করে। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান কেন্দ্রীয় সরকারের সকল গণ-বিরােধী ও অশুভ তৎপরতা নস্যাৎ করবার ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরােপ করেছিল।

৫. বেসামরিক ও সামরিক আমলাচক্রের কর্তৃত্ব লােপ
মূলত বেসামরিক ও সামরিক আমলাচক্রের চক্রান্ত ও দুর্নীতির ইতিহাস মূলত পাকিস্তানের ২৪ বছরে ইতিহাস। উভয় আমলাতন্ত্রই রাজনীতির ক্ষেত্রে তাদের কর্তৃত্ব বিস্তারে সচেষ্ট ছিল এবং তাতে তার যথেষ্ট সফলকামও হয়েছিলেন। তাদের এ অশুভ তৎপরতার ফলেই দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা গড়ে তােলা সম্ভবপর হয় নি। এ কারণেই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও ছাত্রসমাজ উনসত্তরের গণ আন্দোলনের মাধ্যমে বেসামরিক ও সামরিক আমলাচক্রের মূলােৎপাটন করতে সর্বশক্তি নিয়ােগ করে।

জনপ্রিয় সার্চঃ

গণ-অভ্যুত্থান, গণ-অভ্যুত্থান১৯৬৯, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমি,
১৯৬৯ সালের গণ-অত্যুত্থানের কারণ, ১৯৬৯ সালের গণ-অত্যুত্থানের কারণ কি ছিল,
১৯৬৯ সালের গণ-অত্যুত্থানের কারণ ও ফলাফল, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের ফলাফল
এরশাদের পতন
স্বৈরাচার বিরোধী কবিতা
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি ও ফলাফল আলোচনা কর